❑ সাম্য রাইয়ান
নীলাব্জ চক্রবর্তীর সেই পোস্ট—
“হাসপাতাল চললাম। সম্ভবতঃ সামান্য কয়েক রাত। জীবনে এই প্রথম। ফলতঃ একটু নার্ভাস। প্রসঙ্গ, লিভার। জানানো হল। বেশী উদ্বিগ্ন হবেন না। আবার হতেও পারেন। যা ইচ্ছা।” (২০-০৯-২৫)
এখন পড়ে মনে হয়, যেন নিজের শরীরের ভেতর ঘনিয়ে ওঠা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বলেছিলেন—আমি যাচ্ছি, তবে ভয় পেয়ো না। অথচ আমরা জানতাম না, সেই ভয়ই শেষ পর্যন্ত তাকে গ্রাস করবে।
১৯ তারিখ সকালে ঘুম ভাঙতেই দুঃসংবাদটি পেলাম। ১৮ নভেম্বর ২০২৫, রাত ১১টা ৪০—কবি নীলাব্জ চক্রবর্তী মারা গেছেন। সংবাদটি যেন হঠাৎ করে ভেতরের কোথাও গভীর ফাটল তৈরি করল। মনে হল, তার ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দ যেন এখন অন্য অর্থে ঝলসে উঠছে—তিনি আমাদের খুব আগেই সতর্ক করেছিলেন, অথচ বুঝতে পারিনি।
তার মৃত্যু সংবাদ মন প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি। কিন্তু যখন উপলব্ধি করতে শুরু করলাম, তখন বুঝতে পারলাম, তাঁর সেই “বেশী উদ্বিগ্ন হবেন না। আবার হতেও পারেন। যা ইচ্ছা।”– বলার ভেতর ছিল এক ধরণের কবি-দৃষ্টির গহন সংকেত, যেখানে মৃত্যু এক ছায়াময়ী দরজা মাত্র, ভীতিহীনভাবে আতঙ্কের সঙ্গে গাঁথা। এবং আজ, তাঁর অনুপস্থিতিতে, সেই দরজা আমাদের জন্য এক অমোঘ অনুরোধ হয়ে দাঁড়িয়েছে—।
নীলাব্জের কবিতায় প্রায়ই অনুভব হয় সময় ও স্মৃতির এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য — জীবনের ক্ষুদ্র, অভিজাত ফাঁক-ফোকরগুলো তিনি যেভাবে ধরেছেন, তা সাধারণ চিত্র নয়, কিন্তু একটি অন্তরাত্মার মানচিত্র। উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যেতে পারে তাঁর কবিতা “বুকের বরফ / কেমন স্থিতিস্থাপক হল চাঁদে চাঁদে … আমি এই সতর্কবার্তার ভেতর ঢুকে যাচ্ছি…” — এখানে একটি সহজ কিন্তু গভীর অনুভব প্রকাশ পায়: দুঃশ্চিন্তা, অপেক্ষা, সেই অন্তরদৃষ্টির মধ্য দিয়ে “সতর্কবার্তা” শুধু কারণ বা উপাখ্যান নয়, বরং একটি শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো অনুষঙ্গ।
এছাড়া, তাঁর “নিউটাউন” শিরোনামের কবিতায় দেখা যায় কাচ, বাদামী রুটি, পোস্ট-টেনসন তার — সব কিছু মিলিয়ে একটি আধুনিক শহরের ধীর গতির নকশা, যেখানে সময় নিজেই একটা স্বাদ বদলাচ্ছে। ভাষা ও শারীরিক অনুভূতির মিশ্রণ, তাঁর অন্তর্মুখী কণ্ঠকে এক নতুন মাত্রা দেয়।
তার কবিতার পৃথিবীটাকে আরও একটু ধীরে, আরও শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো তাল রেখে দেখতে হবে আমাদের। কেননা অনুভূতির কথা তিনি সশব্দে বলেননি; বরং সে অনুরণন কাগজে বৃষ্টির দাগের মতো লেগে থেকেছে। তার গদ্য, তার ফেসবুকের ছোট ছোট লেখা, আর তার বেড়ে ওঠার ধারাটি—সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন এক “দূরবর্তী আত্মীয়তা”—যাকে চোখে দেখা যায় না, তবু টের পাওয়া যায়। এখন মনে হয়, তিনি আর লিখবেন না, পোস্ট করবেন না, নিজের ভেতরের গানটুকু শোনাবেন না—এটা ভাবতেই শ্বাস আটকে আসে।
নীলাব্জের নিজস্ব ভাষা, স্মৃতির প্রতি তার আন্তরিক নিষ্ঠা, আর বাস্তবকে সবসময় একটু তির্যক দিকে সরিয়ে দেখার অভ্যাস—সব মিলিয়ে তার কবিতা ও গল্পে এক প্রবল অন্তর্জগৎ গড়ে উঠেছিল। সেই অভ্যন্তরীণ উত্তাপে তিনি নিজেকে টিকিয়ে রেখেছিলেন, আর আমরাও তার সেই উত্তাপেই আশ্রয় পেয়েছিলাম।
তার কবিতা এক ধরনের মৌন বোঝাপড়ায় যুক্ত—যেখানে বর্ণনার অধিক আছে অনুভূতির নক্ষত্রমণ্ডলের ভেতর দিয়ে জীবনকে অনুধাবনের চেষ্টা।
তার গল্পেও একই প্রবাহ। তার চরিত্রের কখনো পূর্ণ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না; বরং তারা নিজের অসমাপ্ত রূপেই পাঠকের মনে থেকে যায়। এটি ছিল তার স্বাতন্ত্র্য—অসমাপ্তির মধ্যেই অর্থ খুঁজে নেওয়া।
তার লেখায় শহরের গন্ধ, আলো-অন্ধকারে বসে থাকা কৈশোর, কিংবা ভেঙে যাওয়া প্রেমের অগোচর দগ্ধতা দেখে মনে হয়—তিনি মানুষকে নয়, মানুষের ভিতরের ছায়াকে ধরতে চেয়েছিলেন।চরিত্র তো অনেক লেখকই নির্মাণ করেন; কিন্তু নীলাব্জ চরিত্রের গলিঘুপচি চিনতেন।
তার শেষ দিকের লেখাগুলো পড়লে টের পাওয়া যায়—মানুষ নিজের জীবনকে কত বিচিত্রভাবে বহন করে। অসুস্থতার সময়ে তার ভাষা আরও ধীর ছন্দে রূপ নিতে থাকে, আরও নিবিড় মেদহীন হয়ে ওঠে। মৃত্যু তার কাছে ভয়ের ছিল বলে মনে হয় না; বরং তিনি মৃত্যুকে নিজের মতো করে এক ধরনের অন্ধকার দরজা হিসেবে দেখেছিলেন—যার ওপাশে নিশ্চয় আলো আছে, কিন্তু আমাদের দেখার সুযোগ নেই।
নীলাব্জ চক্রবর্তীর মৃত্যু—এক গভীর প্রয়োজনীয় স্বরের অনুপস্থিতি। এই স্বর তাকে ছাড়া অন্য কেউ তুলে নিয়ে যেতে পারবে না। তিনি যে স্তব্ধতা, যে আলো-ছায়ার পথ রেখে গেলেন—সেটাই এখন আমাদের কাছে আসল উত্তরাধিকার।
তাঁর মৃত্যুতে আমরা শুধু একটি স্বর হারালাম না; আমরা সেই নিঃশব্দ ঘোরটুকুই হারালাম, যা তাঁর প্রতিটি পংক্তি থেকে ধীরে ধীরে স্পন্দিত হয়। আমাদের কাজ অবশিষ্ট সেই স্পন্দনকে ধারণ রাখা, তাঁর বাকি কাব্যকে যত্নের সঙ্গে স্মরণ করা, এবং তাঁর আলো-ছায়ার মানচিত্রে আরেকবার ফিরে যাওয়া।
এমন একজন লেখকের জন্য প্রকৃত শোক লেখা যায় না। শুধু মনে রাখা যায়—তিনি আমাদের জীবনকে একটু বেশি স্পর্শ করতেন, অভ্যন্তরকে আরও সজাগ করতেন, এবং এই কঠিন সময়েও মনে করিয়ে দিতেন—লেখালিখি আসলে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে একটি ছোট আলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
নীলাব্জ চক্রবর্তী সেই আলোটি রেখে গেছেন। আর আমরা, যারা তাকে পড়েছি, তাকে অনুভব করেছি—আমাদের ভেতরের একটি জানালা আজ শূন্য হয়ে গেল।
২১ নভেম্বর ২০২৫