❑ সাম্য রাইয়ান
বাঙলা ছোটোগল্পের অন্দরভুবনে একবিংশ শতাব্দীতে যে রূপগত পরিবর্তন এসেছে, তার ভেতরে কবীর রানার নামটি আলাদা গুরুত্ব নিয়ে উচ্চারিত হবার মতো। তাঁর গল্প প্রথমদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও গভীরে প্রবেশ করলে বোঝা যায়—রাজনীতি, ভাষা, ইতিহাস, স্মৃতি, পৌরাণিক ভাবনা, নগরজট, অন্তর্গত অন্ধকার, অদৃশ্য ক্ষমতা এবং মানুষের একাকিত্ব—এসব মিলেমিশে তাঁর গদ্যের অন্তরালে তৈরি হয় এক তীব্র এবং ধোঁয়াটে রূপকবিশ্ব। ছোটোগল্পের এই গঠনে দৃশ্যমান ঘটনা অপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ‘ঘটনার ভাষা’, এবং ঘটনার ভিতরে জমে থাকা ‘অবচেতনের বিস্তার’। এই বিস্তারই তাঁর গল্পকে সহজপাঠ্য থেকে বহুস্তরীয় বয়নকৌশলে রূপান্তরিত করে।
কবীর রানার গল্পে যে চিত্রলহরি, তা একদিকে গভীরভাবে দেশজ, অন্যদিকে গভীরভাবে উত্তর-আধুনিক বোধের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর গল্পে দেখা যায় মানুষ অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে লড়াই করে, কখনো সেই শক্তি রাষ্ট্র, কখনো সমাজ, কখনো প্রযুক্তি, কখনো স্মৃতি; অথচ সেই শক্তিকে স্পষ্ট নাম দেওয়া হয় না। ফলে গল্পগুলো একধরনের সংকেতভিত্তিক মানচিত্র হয়ে ওঠে, যার ভেতরে পাঠককে নিজস্ব চাবিকাঠি দিয়ে প্রবেশ করতে হয়।
বাঙলা ছোটোগল্পের জগতে আভাস-নির্মিত গদ্যশৈলী খুব বেশি দেখা যায় না, ঠিক এই বিন্দুতেই কবীর রানা প্রবল ব্যতিক্রম। তিনি কখনো হঠাৎ গল্পের কেন্দ্রে রেখেছেন একটি হারিয়ে যাওয়া দরজা; আবার কখনো তুলে ধরেছেন এমন একটি শহর যেখানে বিজ্ঞাপনগুলো রহস্যময়ভাবে বাতাশে মিলিয়ে যায়; কখনো দেখিয়েছেন এমন পরীক্ষা-হল যেখানে একজন শিক্ষার্থী হঠাৎ তার শরীরে এক স্পর্শ অনুভব করে—যার ব্যাখ্যা কেউ দেয় না, কিন্তু সেই অভিঘাত সমাজটিকে ভেতর থেকে উন্মুক্ত করে দেয়।
এভাবে, কবীর রানা তার গল্পে বাস্তবতাকে ঠাঁই দিলেও একথা বলতে হয়—বাস্তবতাই তার গল্পের শেষ সত্য নয়। বাস্তবতাকে গল্পে এনে তিনি তার ওপর নির্মাণ করেন রূপকের একটি নতুন, কুয়াশামাখা ভূগোল—যার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পাঠক নিজেকেও নতুনভাবে আবিষ্কার করেন।
□
নতুন শতকের বাঙলা ছোটোগল্প ক্রমশ যখন সারল্য, স্মৃতিনির্ভর রোমান্থন কিংবা দৈনন্দিন বাস্তবতার সরাসরি প্রতিবেদনধর্মী বয়ানের দিকে ঝুঁকছিল, তখন কবীর রানা সেই প্রবাহের পাশে দাঁড়িয়ে তৈরি করছিলেন আরেকটি পথ—যেখানে গল্পের মূল শক্তি ঘটনাপুঞ্জে নয়, ঘটনার মধ্যবর্তী অংশে, ভাষার ভিতরের গোপন চলনে। এই কারণে তাঁর গল্প পাঠের মধ্য দিয়ে তাকে ঘিরে থাকা বায়ুমণ্ডল—অর্থাৎ অনুভূতির ধূসরতা, অজানা আতঙ্ক, চিহ্নহীন সংকেত, এবং বাস্তবের ভেতর লুকোনো পরাবাস্তব গাঁথুনি—এসবও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রানা গল্পকে ব্যবহার করেন একপ্রকার ক্ষেত্র-পরীক্ষা হিসেবে, যেখানে সামাজিক সজ্জা, ক্ষমতার বলয়, নাগরিক জীবনের বহুমাত্রিক দোলাচল কিংবা স্মৃতি-অচেতন—এসবকে একেকটি বিমূর্ত শক্তি হিসেবে হাজির করা হয়। ফলে তাঁর গল্পে দৃশ্যমান ‘কী ঘটল’—এর চেয়ে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় ‘কেন ঘটল’, কিংবা তারও গভীরে—‘ঘটনার শূন্যে পাঠক কী শুনতে পেলেন’।
এই বোধটি বুঝতে হলে পাঠককে গল্পের প্রচলিত কাঠামো থেকে একটু সরে আসতে হয়। রানা আমাদের সামনে এমন চরিত্র হাজির করেন, যারা কখনো শহরের ভিতরে উড়ে যাওয়া বিজ্ঞাপনের সঙ্গে লড়াই করছে, কখনো নিজের ঘর থেকে হারিয়ে যাওয়া দরজার অনুসন্ধানে পথ হারাচ্ছে, কখনো আবার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার দমবন্ধ করা নির্দেশের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাইছে। এই চরিত্ররা সাধারণ মানুষের প্রতিরূপ হলেও, তাদের অভিজ্ঞতা সাধারণ থাকে না; বরং ধীরে ধীরে রূপ নেয় প্রতীকে। গল্পের কার্যকারিতা এখানেই—চরিত্র যেন তার সংকটের ভাষা হয়ে ওঠে, গল্প যেন তার সময়ের সমগ্র অভিঘাত বহন করে।
এইসব কারণেই কবীর রানার গল্প একক অভিজ্ঞতার সীমা পেরিয়ে এক যুগের সামষ্টিক পাঠ হয়ে ওঠে। তাঁর অভিনব চিত্রকল্প—যেমন বনের ভেতর গভীর রাতে দাঁড়িয়ে থাকা দরজাবিহীন বৃদ্ধ, কিংবা এমন তরুণেরা যারা নিজেদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ইন্টারনেটে আপলোড করে অমরত্ব খোঁজে—এসবই আমাদের যুগের গভীর মানসিক সংকটকে প্রতীকী কাঠামোয় ধরে ফেলে। এমনকি যখন তিনি একটি ক্ষুদ্র গ্রাম বা একটি অবহেলিত জনপদের কথা বলেন, তখনও স্থানীয়তার সংকীর্ণ গণ্ডিতে সেই আখ্যান ভেঙে পড়ে না; বরং ছড়িয়ে পড়ে সামগ্রিক মানবজিজ্ঞাসায়। এতে বোঝা যায়, তাঁর গল্পে স্থান-কালিতার ভৌগোলিক সীমানা গুরুত্ব পেলেও সেটি গল্পের চূড়ান্ত আগ্রহ নয়; আগ্রহ হলো মানুষের অস্তিত্বের ধারাবাহিকতা, এবং সেই ধারাবাহিকতার ভেতরে জন্ম নেওয়া অনিশ্চয়তা।
এমন স্বাতন্ত্র্যই পাঠকের সামনে এক ধরনের প্রস্তুতির দাবি তোলে। পাঠককে প্রস্তুত থাকতে হয় গল্পের ভেতরে হঠাৎ খোলা অগণিত দরজা কিংবা সিঁড়ির জন্য, প্রস্তুত থাকতে হয় ভাষার ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে থাকা ভাষার গোপন নকশা অনুধাবন করার জন্য। ঠিক এই জায়গাতেই তাঁর গল্পগুলো হয়ে ওঠে একেকটি অভিজ্ঞতা, যার ভেতরে পাঠকের নিজস্ব বোধও ধীরে ধীরে আকার বদলায়।
এই প্রেক্ষাপটে এবার তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প—‘হাত’, ‘রাজহাঁসগুলো আমাদেরকে ধর্ষণ করেছিলো’, ‘মেয়াদোত্তীর্ণ নিরাপত্তাসমূহ’, ‘বিজ্ঞাপন চুরি হয়ে যাচ্ছে’, ‘দরজা’, ‘পদ্মপুকুর’, ‘কেউ চুম্বন করেনি’, ‘জমির দলিল বিক্রি করা হবে’—প্রতিটির উপর বিশদ প্রতিক্রিয়া তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। কারণ প্রতিটি গল্পই কবীর রানার নির্মিত ওই রূপকবিশ্বের আলাদা আলাদা জানালা, এবং প্রতিটি জানালার দৃশ্যপট ভিন্ন, অথচ পরস্পরকে ছায়ার মতো স্পর্শ করে যায়। এখন সেই গল্পগুলোর দিকে আলাদাভাবে এগোনোর আগে এটি মনে রাখা জরুরি—এই গল্পগুলো পড়তে গেলে আমাদের পূর্বানুমান, অভ্যাসগত পাঠপ্রণালী ও অর্থ-অন্বেষণের সহজ সূত্রগুলো সাময়িক বিরতি নেয়; ফলে পাঠক ধীরে ধীরে প্রবেশ করেন এমন এক ভূগোলে, যেখানে অর্থ আসে বিক্ষিপ্ত ছায়া থেকে, অসমাপ্ত দৃশ্য থেকে, এবং চরিত্রের অভ্যন্তরের অনিশ্চয়তাপূর্ণ দোদুল্যমানতা থেকে।
এই সেতুবিন্দুটি মাথায় রেখে তার গল্প পাঠের দিকে এগোনোই যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে করি।
□
কবীর রানার অন্যতম শক্তিশালী গল্প ‘হাত’। গল্পটি পড়লে মনে হয় যেন পরিচিত একটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ভেতরে কোনো সাধারণ ঘটনা ঘটছে—এক শিক্ষার্থীর শরীরে পরীক্ষার সময় একটি হাত এসে পড়েছে। কিন্তু খুব দ্রুতই বোঝা যায়, এই ঘটনার ভেতর লুকিয়ে আছে ক্ষমতার কাঠামো, জ্ঞানের রাজনীতি, এবং শরীরকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া আধিপত্যের মানচিত্র। রিয়া যখন বলে “বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আসলে শরীরচর্চার ক্ষেত্র”, তখন সে শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের ভাষাহীন দুর্নীতি তুলে ধরে না, বরং দেখিয়ে দেয় একটি সমাজ কীভাবে জ্ঞানের আড়ালে শরীরকে অঙ্কিত ও সংজ্ঞায়িত করে।
গল্পটির শক্তি এই যে, ‘হাত’ এখানে একটি ঘটনা নয়; এটি একটি প্রতীক, এমন প্রতীক যার ভেতরে লুকিয়ে আছে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার অসঙ্গতি, লিঙ্গ-রাজনীতির অদৃশ্য চাপ, এবং প্রতিষ্ঠানের ভেতরের ক্ষমতার বলয়। রিয়া যখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানায়, তখন গল্পে দেখা যায় “হাত” নিয়ে সমাজের যুক্তিকাঠামো কেমন জট পাকিয়ে যায়। আলোচনা, তর্ক, নৈতিকতা—সবকিছু মিলে একধরনের বিকৃত নাট্যমঞ্চ তৈরি করে। গল্পটির আড়ালে তাই শুধু নারী-শরীরের নিয়ন্ত্রণ নয়—এখানে উঠে আসে জ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি বৃহত্তর যন্ত্রের ছবি।
□
অন্যদিকে, ‘দরজা’ গল্পে আমরা দেখি এক বয়স্ক কাঠমিস্ত্রি আফসারকে—যার জীবনের সারাংশ জন্ম থেকেই দরজা তৈরি করা, কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে এসে সে নিজের ঘরের দরজাগুলো খুঁজে পাচ্ছে না। সন্তানরা কোথায় যেন সেগুলো সরিয়ে ফেলেছে। দরজা না থাকায় সে একটি অদ্ভুত যাত্রায় বেরিয়ে পড়ে—অরণ্যে যায়, গাছগুলোর সামনে দাঁড়ায়, এবং উপলব্ধি করে গাছই আসলে দরজার আদিস্বজন। এই ‘আবিষ্কার’ তার ভিতরের দীর্ঘদিনের অপরাধবোধকে স্পর্শ করে—সে বুঝতে পারে, যেসব গাছকে কেটে সে সারাজীবন বসবাসের জন্য দরজা তৈরি করেছে, সেই গাছই ছিল তার অস্তিত্বের ছায়া।
এই গল্প মূলত মানুষের শ্রমজীবনকে অন্য আলোয় দেখায়। আফসার দরজা বানিয়ে সারাজীবন কাটিয়েছে, কিন্তু সে কখনো তার নিজের জীবনের ‘খোলা-বন্ধ’ হওয়ার জায়গাকে বুঝতে পারেনি। গল্পটি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক প্রশ্ন ছুঁয়ে যায়—আমাদের জীবনে যে দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যায় বা হারিয়ে যায়, সেগুলোর প্রকৃত আকার কোথায়? আমরা কি সত্যিই জানি— কোন দরজায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি?
□
‘বিজ্ঞাপন চুরি হয়ে যাচ্ছে’ গল্পটি এক অদ্ভুত শহরকেন্দ্রিক রূপকে ভরপুর। যেখানে প্রতিদিনের খবরে দেখা যায়—বাড়িভাড়া, চাকরির নিয়োগ, মানুষের আপাত প্রয়োজনের বিজ্ঞাপনগুলো হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এই বিজ্ঞাপন হারিয়ে যাওয়াকে তিনি শুধু শহরের অস্থিরতা হিসেবে দেখান না, বরং একটি অর্থনৈতিক ও মানসিক সংকটের ইঙ্গিত হিসেবে ব্যবহার করেন।
নগরে মানুষের জরুরি প্রয়োজনের তথ্য—যা সাধারণত প্রকাশিত হয় বিজ্ঞাপনে—সেগুলো হারিয়ে যাওয়া মানে শহরের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক গোপন কাঠামো ব্যাহত হওয়া। আর গল্পের আড়ালে স্পষ্ট যে আধুনিক শহর এমনভাবে নির্মিত— সেখানে মানুষের ব্যক্তিগত প্রয়োজনও ধীরে ধীরে একটি অশরীরী ব্যবস্থার হাতে চলে যায়। বিজ্ঞাপন হারিয়ে যাওয়ার এই পরাবাস্তব ঘটনাটি বাস্তবের ওপরই দাঁড়িয়ে থাকে, এবং পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে—কীভাবে শহর আমাদের জীবনের নিত্য প্রয়োজনের তথ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে।
□
‘জমির দলিল বিক্রি করা হবে’ গল্পে সাতমাথা শহরের এক ‘মেথরপট্টি’-র কথা উঠে আসে—যেখানে রাস্তা পরিষ্কার করা শ্রমজীবী মানুষরা বহু বছর ধরে থাকে, অথচ কোনো দলিল নেই, কোনো মালিকানা নেই। এই গল্পে কবীর রানা দৃশ্যত বাস্তবতার ভিতর দিয়ে আঘাত করেন—কেন এই লোকগুলো শহরকে পরিষ্কার রাখলেও শহর তাদের ঠিকানা স্বীকৃতি দেয় না? কীভাবে মালিকানার রাজনীতি গড়ে ওঠে, এবং সেই রাজনীতির আড়ালে কীভাবে মানুষকে অদৃশ্য করে রাখা হয়?
এই গল্পের মূল শক্তি তার সংযমী ভাষায়। রানা কখনো আবেগী হন না, বরং ঘটনাগুলোই এখানে কাজ করে প্রধান শক্তি হিসেবে। জমির দলিল, একটি কাগজ—যার মূল্য শূন্যও হতে পারে, আবার জীবন-মৃত্যুর সিদ্ধান্তও দিতে পারে—এই কাগজকেন্দ্রিক গল্পটি আসলে রাষ্ট্রের একটি গুরুত্ববহ দার্শনিক প্রতীক চিহ্নিত করে।
□
‘রাজহাঁসগুলো আমাদেরকে ধর্ষণ করেছিলো’ গল্পটি রানা-গদ্যের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ—রাজনীতি, দেহ, ইন্টারনেট-বাস্তবতা এবং সমষ্টিগত উন্মাদনা। গল্পের শুরুতে দেখা যায় নির্বাচনের সময় নাগরিকদের বলা হচ্ছে—“নগরের বাক্সে জমা আছে আমাদের হাত।” হাতকে শুধু ভোটের প্রতীক নয়, ব্যক্তিসত্তার সনদ হিসেবে এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। ভোটের সময় হাত তোলা, হাতের তালিকা, হাতের নথি—সব মিলিয়ে একটি বিকট প্রশাসনিক রূপকে তৈরি করে।
গল্পের পরবর্তী অংশ আরও ভয়াবহভাবে চিত্রিত হয়—মানুষজনকে বলা হয়, পরিচয়পত্র হারালে মানুষ হাত-পা-গৃহ সব হারাবে। গল্পে তরুণেরা নিজেদের অনুভূতি বাঁচাতে হাত-পা ইন্টারনেটে আপলোড করে বলে, “ইন্টারনেট আমাদের অমর করে তুলেছে।”
এখানে কবীর রানা যে আধুনিকতা-বিশ্লেষণ করেছেন তা অসাধারণ—ইন্টারনেটে আপলোড মানেই অমরতা—এমন ধারণা আজকের তরুণ প্রজন্মের গভীর ভয় ও অস্থিরতার প্রতিচ্ছবি। এ যেন এক ডিজিটাল যুগের পুরাণ, যেখানে মানুষ নিজের শরীরকে মেঘে ভাসিয়ে ‘অমরত্ব’ খোঁজে।
□
‘পদ্মপুকুর’ গল্পকে শহরের আর্কিটেকচার-দর্শন হিসেবে পড়া যেতে পারে। গল্পে সেউজগাড়ি নামে একটি শহরের কথা বলা হয়েছে, যেখানে মরুভূমি থেকে ছায়া এনে উঁচু দালান নির্মাণ করা হয়। শহরেচিহ্নগুলো এত বিশাল যে মানুষ আকাশ দেখতে পারে না। পরে বোঝা যায়—শুধু ইট-সিমেন্ট দিয়ে শহর নির্মাণ করলে চলে না; মানুষের দৃষ্টি কোথায়, মানুষের অস্তিত্ব কোথায়—সেটিও বিবেচ্য।
এ গল্পটি অত্যন্ত সমকালীন—দালান দিয়ে আকাশ ঢেকে ফেলা মানে মানুষের মনকেও ঢেকে ফেলা। ফলে গল্পটি শুধু স্থাপত্য নয়, মানুষের জীবনপ্রকল্প নিয়েও প্রশ্ন তোলে।
□
সবশেষে, ‘মেয়াদোত্তীর্ণ নিরাপত্তাসমূহ’—যা কবীর রানার অন্যতম জটিল গল্প। গল্পটি বিভিন্ন খণ্ডচিত্রে গঠিত, এবং প্রতিটি খণ্ড একটি নিরাপত্তা-ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে: পরিবার, রাষ্ট্র, পরিচয়, ঘর, ভাষা—এইসব স্বতঃসিদ্ধ নিরাপত্তা-ব্যবস্থা গল্পে অদ্ভুতভাবে ভেঙে পড়ে।
গল্পটি খুবই কাব্যময় বলে একাধিক পাঠক একে ‘চিত্রকল্পের বিস্ফোরণ’ বলে অভিহিত করেছেন। এই গল্পে রানা ঠিক ‘ঘটনা’ লেখেননি; বরং লিখেছেন নিরাপত্তাহীনতার এক দীর্ঘ কাব্যগদ্য, যেখানে পাঠককেই নিজস্বভাবে ব্যাখ্যা করতে হয়। খণ্ডচিত্রগুলো একেকটি অস্থির মানসিক অবস্থা ফাঁস করে দেয়।
□
এই সব গল্প একত্রে পড়লে বোঝা যায়—কবীর রানা ছোটোগল্পকে কেবল গল্প বলার মাধ্যম হিসেবে দেখেন না। তাঁর কাছে গল্প মানে প্রশ্নের বহুবিশ্ব—যেখানে মানুষের জীবন একটি ভৌগোলিক মানচিত্র, আবার একইসঙ্গে মানসিক অরণ্য। কখনো অদৃশ্য হাত, কখনো অদৃশ্য দরজা, কখনো অদৃশ্য বিজ্ঞাপন, কখনো অদৃশ্য পরিচয়—এসব মিলিয়ে একটি অচেনা কিন্তু ভয়ানকভাবে পরিচিত পৃথিবী।
এই পৃথিবী পাঠককে শুধু ভাবায় না; তাকে নিজের ভেতর তাকাতেও বাধ্য করে। আজকের ডিজিটাল যুগে মানুষের বিচ্ছিন্নতা, প্রযুক্তিগত নির্ভরতা, মালিকানার রাজনীতি, নগরের অজস্র দিক এবং রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ—এসবের মাঝখানে কবীর রানার গল্পগুলি এক ধরনের সতর্কতার ঘন্টা বাজায়।
বাঙলা ছোটোগল্পে যেখানে আগে গল্প বলতে বলতে চরিত্রের জীবন তুলে ধরা হতো, সেখানে কবীর রানা চরিত্রের জীবন নয়—জীবনের প্রতীকী দোকানঘর, রাস্তা, দরজা, ছায়া, শরীর, দলিল—এসব ব্যবহার করে গড়ে তোলেন মানুষের মনস্তত্ত্বের অদৃশ্য কাঠামো।
তার গল্পে পাঠক আপাতভাবে অস্বস্তি অনুভব করতে পারে, আর তাতেই গল্পের সার্থকতা। যে গল্প পাঠকের মধ্যে জিজ্ঞাসা তৈরি করতে পারে, সে-ই তো টিকে থাকে নাকি?