ভালোবাসা, শ্রম ও বিপ্লবের ‘ইশতেহার’

❑ সাম্য রাইয়ান 

রাজনৈতিক কবিতা বলতে আমরা সাধারণত সেই কবিতাকেই বুঝি, যেখানে সমাজ, রাষ্ট্র, শ্রেণিবিন্যাস, শোষণ, বিপ্লব ও মানবমুক্তি নিয়ে ভাবনা কাব্যের ভাষায় প্রকাশ পায়। কিন্তু প্রকৃত রাজনৈতিক কবিতা কখনোই দলীয় প্রচারণা নয়; বরং তা মানুষের অস্তিত্ব, ন্যায়বোধ, ও স্বপ্নের কাব্যিক অনুবাদ। কবিতা তখনই রাজনৈতিক হয়ে ওঠে, যখন তা ক্ষমতার কেন্দ্রে আঘাত করে, ব্যক্তি ও সমাজের অদৃশ্য বৈষম্যের রেখা উন্মোচিত করে, এবং মানুষকে তার নিজস্ব মর্যাদা ও শক্তি সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। বাঙলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম থেকে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ পর্যন্ত এই রাজনৈতিক কবিতার ধারা গড়ে উঠেছে—যেখানে প্রেমও রাজনৈতিক, শরীরও রাজনৈতিক, আর দ্রোহও গভীর মানবিকতার ভাষা। রুদ্রের ইশতেহার এই ধারার এক অনবদ্য ও সমকালীন প্রতিধ্বনি—যা ইতিহাসের ছায়া ও ভবিষ্যতের আলো একসঙ্গে ধারণ করে, এবং মানুষের আত্মমুক্তির ভাষায় রচিত হয় এক বিস্তৃত মানবিক ম্যানিফেস্টো হিসেবে।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ইশতেহারকে বলা যেতে পারে আদিম সাম্যবাদী স্মৃতির প্রতি আহ্বান এবং ভবিষ্যৎ সমতার কাব্যিক মানচিত্র। এটি সেই দীর্ঘশ্বাস, যা ইতিহাসের স্তরে স্তরে জমে থাকা মানুষের নিস্পৃহতা, প্রতারণা, প্রেম, সংগ্রাম, ও মৃত্যুর সমবেত প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে। এখানে কবি নিজেকে একজন একক কণ্ঠ নয়, বরং এক সমষ্টিগত আত্মার প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত করেন।

রুদ্রের এই কবিতা বিশ্বকবিতার সেই দীর্ঘ ধারার অংশ, যেখানে কবিরা ভাষাকে রাজনৈতিক চেতনার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যেমন পাবলো নেরুদার Canto General লাতিন আমেরিকার আদিবাসী ও শ্রমজীবীদের কণ্ঠ হয়ে ওঠে, তেমনি রুদ্রের ইশতেহার বাঙলাদেশের কৃষক, শ্রমিক ও নিপীড়িত মানুষের স্বপ্নের প্রতিধ্বনি। নেরুদা যেমন সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শ্রম ও ভালোবাসাকে পুনর্দখল করতে চান, রুদ্রও ঘোষণা করেন—“আমাদের পুরুষেরা সুলতানের ছবির পুরুষের মতো স্বাস্থ্যবান, কর্মঠ আর প্রচণ্ড পৌরুষদীপ্ত হবে।” উভয় কবিই বিশ্বাস করেন, মানবমুক্তির ভিত্তি গড়ে ওঠে শ্রম, শরীর ও শিল্পের সম্মিলনে।

কবিতাটি শুরু হয় আদিম মানবসমাজের এক নিস্পাপ সমতার কল্পচিত্র দিয়ে—যেখানে মানুষ প্রকৃতির সন্তান, ভূমির কোনো মালিকানা নেই। এই কৌমজীবনে শরীর ও প্রকৃতি একে অপরের পরিপূরক। “আমরা তখন সোমরস, নৃত্য আর শরীরের পবিত্র উৎসব শিখেছি”—এই পংক্তি শরীরের ভোগবাদী বন্দনা নয়; বরং মানুষের অস্তিত্বে শরীরের স্বাভাবিকতা ও পবিত্রতাকে পুনরুদ্ধারের ঘোষণা। কিন্তু পরমুহূর্তেই কবি ঘোষণা করেন: “তারপর—কৌমজীবন ভেঙে আমরা গড়লাম সামন্ত সমাজ।” এখানেই শুরু হয় মানবসভ্যতার ট্র্যাজেডি। আত্মরক্ষার অস্ত্র পরিণত হয় দমনযন্ত্রে, কৃষি ও যন্ত্র সভ্যতা হয়ে ওঠে শৃঙ্খলের প্রতীক। “আমাদের নির্মিত যন্ত্র শৃঙ্খলিত করলো আমাদের”—এই পংক্তিতে কবির ইতিহাসচেতনা এক দার্শনিক স্তরে পৌঁছে যায়।

মানুষ বারবার খাঁচা তৈরি করে, আবার ভাঙে, আবার বন্দি হয়—এই চক্রই রুদ্রের ইতিহাসবোধের কেন্দ্র। “আমরা আবার খাঁচা বানিয়েছি, আবার বন্দি হয়েছি, আবার একা হয়ে গেছি”—এই স্বীকারোক্তি কেবল এক ব্যক্তির নয়, সমগ্র মানবজাতির অস্তিত্বগত একাকিত্বের প্রতীক।

এখানেই জন্ম নেয় কবিতার কেন্দ্রীয় ‘আমি’। এই ‘আমি’ কেবল রুদ্র নন—তিনি মুক্তিযুদ্ধের তরুণ, শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধি, এক বঞ্চিত নাগরিক, এবং এক চিরদ্রোহী মানবপ্রাণ। “সে আমি”—এই পংক্তিটি যেন সমগ্র কবিতার হৃদস্পন্দন। এখানে ব্যক্তিগত জীবন ও ইতিহাস পরস্পরে মিশে যায়; আত্মজৈবনিক যন্ত্রণা পরিণত হয় সম্মিলিত মানবস্মৃতিতে।

রুদ্রের ‘আমি একা’ উচ্চারণটি এক অর্থে ওয়াল্ট হুইটম্যানের Song of Myself-এর প্রতিধ্বনি হলেও প্রকৃত অর্থে এটি তার প্রতিবাদ। হুইটম্যানের ‘আমি’ আত্মবিশ্বাসী ও বিশ্বজনীন; রুদ্রের ‘আমি’ ক্ষতবিক্ষত, দমিত, এবং সামাজিক কাঠামোর বন্দি। তবু উভয়ের মধ্যেই মানুষের প্রতি অগাধ আস্থা বিদ্যমান। রুদ্রের একাকিত্ব কোনো হতাশা নয়—এটি সেই প্রস্তুতি, যেখান থেকে নতুন সমাজের স্বপ্নের সূচনা হয়।

এই একাকিত্ব থেকে সমতার দিকে যাত্রাই রুদ্রের ইশতেহার-এর মর্ম। “আমার জীভ কাটা / তবু এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন আমাকে কাতর করে”—এই স্বীকারোক্তি প্রমাণ করে, কবির ভাষা ক্ষতবিক্ষত হলেও তাঁর আশা অক্ষয়। কবি জানেন, পৃথিবীর চিকিৎসা বিজ্ঞানে নয়, বরং মানবিকতায়। “আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান নিরোগ করবে পৃথিবীকে”—এই স্বপ্ন কোনো ইউটোপিয়া নয়; বরং বিজ্ঞান ও মানবতার মেলবন্ধনে বিশ্বাসী এক সমাজচিন্তার প্রতিধ্বনি। তাঁর পৃথিবীতে নারী শ্রমবতী ও লাবণ্যময়ী, পুরুষ কর্মঠ, শিশু সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। এখানে শরীর, শ্রম ও স্বপ্ন পরস্পরের পরিপূরক হয়ে ওঠে।

কিন্তু এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে একদল ‘সামান্য কিছু মানুষ’—যারা সবচেয়ে কম শ্রম দেয়, অথচ সবচেয়ে বেশি সম্পদ ভোগ করে। তারা সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্মের নামে তৈরি করেছে এক ভয়ংকর কারাগার। তাদের পুরুষেরা কদাকার, নারীরা কৃত্রিম, তারা মানবতাবিরোধী। রুদ্র তাদের বলেন “অতিকায় কদাকার বন্যমানুষ।” কবিতার অন্তিম পর্বে তিনি আহ্বান জানান—এই কারাগার ভেঙে, এই মানুষগুলিকে অতিক্রম করে, আবারও একটি উৎসবমুখর সমতার পৃথিবী গড়ার।

রুদ্রের ভাষা এখানে ঘোষণা, অভিশাপ, প্রার্থনা ও স্বপ্নের এক মিশ্র ধ্বনি। “আমরা উৎসব করবো শস্যের / আমরা উৎসব করবো পূর্ণিমার”—এই পংক্তিগুলো এক শোষণহীন ভবিষ্যতের প্রতীক। এই কবিতা তাই একাধারে ইতিহাসের রূপক ও ভবিষ্যতের ম্যানিফেস্টো।

এখানে তুলনা টানা যায় আমেরিকান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের Howl-এর সঙ্গে। Howl যেমন এক ক্ষতবিক্ষত প্রজন্মের আর্তনাদ—“I saw the best minds of my generation destroyed by madness”—তেমনি রুদ্রের ইশতেহারও এক ভাঙন ও বিশ্বাসহীন সময়ের আত্মপ্রত্যয়। গিন্সবার্গ যেমন মার্কিন ভোগবাদী সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়ান, রুদ্র তেমনি উপনিবেশোত্তর দুর্নীতিপূর্ণ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। ভাষা দুই কবির হাতেই পরিণত হয় অস্ত্রে; ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা রূপ নেয় সামাজিক ঘোষণাপত্রে।

একইভাবে বার্টোল্ট ব্রেখটের To Those Born Later কবিতার সাথেও ইশতেহার-এর আত্মিক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ব্রেখট লিখেছিলেন “in the dark times”–এ জন্মানো এক হতাশ প্রজন্মের কথা; রুদ্রও লিখেছেন এমন এক সময়কে কেন্দ্র করে, যখন মানুষ বারবার খাঁচায় বন্দি হয়েও মুক্তির স্বপ্ন দেখে। এই দুই কবিতাই মানবিক চেতনার ঘোষণাপত্র—একদিকে ইউরোপের ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রতিবাদ, অন্যদিকে বাঙলাদেশের পরাজিত স্বাধীনতার অন্তর্গত শোক ও সম্ভাবনা।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ইশতেহার আধুনিক বাঙলা কবিতার এক ব্যতিক্রমী মাইলফলক। এর ভেতরে আছে গদ্য ও কাব্যের সীমা অতিক্রমের সাহস, ইতিহাস ও দর্শনের সংলাপ, ব্যক্তি ও সমাজের দ্বন্দ্ব, এবং প্রেম ও বিপ্লবের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। এই কবিতা একাধারে মানবিক আর্তি ও দার্শনিক ঘোষণা। এর মধ্যে যে দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমশ উন্মোচিত হয়, তা কেবল সমাজ-রাজনৈতিক নয়, নন্দনতাত্ত্বিকও বটে। তিনি বিশ্বাস করেন, কাব্যিক সৌন্দর্য ও রাজনৈতিক চেতনা পরস্পরবিরোধী নয়; বরং তারা একই মানবিক অন্তঃসত্তার দুটি রূপ। রুদ্র এখানে এক নতুন ভাষার জন্ম দেন—যেখানে বিপ্লব কোনো রোমান্টিক কল্পনা নয়, বরং উৎপাদন-সম্পর্কের সম্প্রসারিত রূপ। তাঁর ‘আমরা উৎসব করবো পূর্ণিমার’ উচ্চারণে যেমন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আত্মীয়তা ফিরে আসে, তেমনি ‘আমার জীভ কাটা’–র যন্ত্রণা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সত্য ভাষার মূল্য আজও রক্তে পরিশোধ করতে হয়। এই দ্বৈত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই রুদ্র এক নতুন কাব্যতত্ত্ব নির্মাণ করেন—যা দুঃখের মধ্যেও আশার, হতাশার মধ্যেও মানবমুক্তির, আর ব্যক্তিগত ক্ষতের ভেতর দিয়েও সামাজিক স্বপ্নের কবিতা হয়ে ওঠে।

আজও এই কবিতা অনিবার্য, কারণ পৃথিবী এখনো বিশ্বাসহীন, সমাজ উৎসবহীন, রাষ্ট্র বন্দি। তাই ইশতেহার কেবল কাব্যিক স্বপ্ন নয়, এটি এক সতর্ক উচ্চারণ—যা না শুনলে ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকার হবে। এই কবিতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, মানুষের মুক্তি কোনো রাষ্ট্রনির্ভর পরিকল্পনায় নয়; বরং যৌথ স্বপ্নে, সম্মিলিত ন্যায়বোধে, আত্মিক বিপ্লবে।

শেষমেশ, ইশতেহার এমনই প্রতিবিম্ব—যেখানে আমরা দেখি নিজেদের মুখ, আমাদের সময়ের মুখ, শাসকের মুখোশ। এবং কবি ঘোষণা করেন—এই মুখোশ একদিন খুলে ফেলতেই হবে। এই প্রত্যয়ের কবিতা ইশতেহার। এটি কেবল রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর নয়—এটি আমাদের সকলের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সেই ‘আমি’-র কবিতা, যে এখনো একা, কিন্তু বিদ্রোহে নিবেদিত। এর প্রতিটি পংক্তি মানুষের প্রতি কবির দায়বদ্ধতার সাক্ষ্য, আর প্রতিটি স্বপ্ন নৈতিক প্রতিরোধের প্রতীক। আজকের বিশ্ব যখন নতুন রূপে শোষণ, যুদ্ধ, ও বিভাজনের মধ্যে নিমজ্জিত, তখন ইশতেহার আমাদের জানান দেয়—কবিতা কেবলই সৌন্দর্যের চর্চা নয়, সত্য উচ্চারণের সাহস। রুদ্র তাঁর কণ্ঠে সেই সাহসেরই ধারাবাহিকতা নির্মাণ করেছেন; তাই তাঁর ইশতেহার আজও সমকালীন, আজও বিপ্লবী। এটি এমন এক কবিতা, যা আমাদের পুনরায় আহ্বান করে মানুষের প্রতি বিশ্বাস রাখতে, একাকিত্বের ভিতর থেকেও সমতার পথ চিনতে, এবং বারবার পতনের পরও উঠে দাঁড়াতে—ভালোবাসার, শ্রমের, আর মুক্তির ইশতেহার হয়ে।

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *