ডিগ্রীর কারখানায় জ্ঞানের মৃত্যু

❑ সাম্য রাইয়ান 

আজ শিক্ষক দিবস। এ দিনে শ্রদ্ধার ফুলের চেয়ে বেশি জরুরি প্রশ্ন করা—এই শিক্ষাব্যবস্থায় আসলে আমরা কী উদযাপন করছি? যে দেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের প্রথম পাঁচশোর তালিকায় নেই, যে দেশে স্নাতক ডিগ্রির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলে না, যে দেশে শিক্ষকরা জ্ঞান নয়, প্রশাসনের অনুমোদনে বাঁচেন—সে দেশে শিক্ষক দিবস এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা। আমরা উৎসব করছি, অথচ শিক্ষার মান তলানিতে নেমে গেছে। জ্ঞানের চর্চা হারিয়েছে, কেবল ডিগ্রি বেচাকেনা চলছে। শ্রেণিকক্ষ এখন আর চিন্তার ক্ষেত্র নয়, বরং চাকরির প্রশিক্ষণকেন্দ্র। শিক্ষক দিবস তাই উদযাপনের নয়, লজ্জা ও প্রতিবাদের দিন। একদিকে শিক্ষানীতির নামে ব্যবসা, অন্যদিকে শিক্ষাব্যবস্থায় অন্ধ আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ—এই দুইয়ের সংঘর্ষে বাঙলাদেশের শিক্ষা আজ নিস্পৃহ, জীর্ণ, পরাজিত এক প্রতিষ্ঠান।

দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর বলেছিলেন,
 
 “বস্তুত বিদ্যাশিক্ষার অনেক ডিগ্রী আছে, কিন্তু জ্ঞানের কোন ডিগ্রী নেই৷ জ্ঞান ডিগ্রীবিহীন ও সীমাহীন৷” 
 
অথচ এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে ডিগ্রি অর্জনই শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য, জ্ঞান নয়। বিশ্ববিদ্যালয় মানে আজ ‘চাকরি পাওয়ার লাইসেন্স অফিস’। শিক্ষকরা জ্ঞানের অনুশীলক নন, বরং প্রশাসনিক নির্দেশের অনুসারী কেরানি। গবেষণার জায়গা দখল করেছে নকলপত্র, তোষণমূলক থিসিস, এবং পদোন্নতির রাজনীতি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের মুক্ত চিন্তা নয়, বরং আনুগত্য শেখাচ্ছে—ক্ষমতার প্রতি, দাতাদের প্রতি, অথবা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রতি।

বাঙলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনোটি আজও QS World University Ranking বা Times Higher Education Ranking–এর প্রথম পাঁচশোর মধ্যে নেই। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান, এমনকি ভিয়েতনাম পর্যন্ত তাদের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। কারণ তারা অন্তত গবেষণা, মৌলিক চিন্তা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্ব বুঝেছে। আমরা বুঝিনি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্ষমতার প্রান্তিক কার্যালয় বানিয়েছি।

শিক্ষার মান পতনের আরেকটি চিহ্ন—দেশের স্নাতক ও ফাউন্ডেশন কোর্সের মান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়। এমনকি বাঙলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক প্রোগ্রামই WES (World Education Services) বা UK ENIC–এর মানদণ্ডে স্বীকৃতি পায় না। এর মানে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ আন্তর্জাতিকভাবে প্রায় অকার্যকর। অথচ এই সনদ নিয়েই হাজারো তরুণ-তরুণী বিদেশে গিয়ে ব্যর্থ হয়, অপমানিত হয়। এর দায় কে নেবে?

আজকের শিক্ষক দিবসে প্রশ্ন একটাই: এই ব্যবস্থায় শিক্ষক বলতে আমরা কাকে বুঝি? যিনি শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেন, নাকি যিনি প্রশাসনিক চেয়ারে বসে শিক্ষকদেরই দমন করেন? শিক্ষকরা যদি ন্যায় ও নীতির কণ্ঠস্বর না হন, যদি তাঁরা প্রতিরোধের ভাষা রচনা না করেন, তবে তাঁরা শিক্ষার্থী নয়, কেবল পদস্থ কর্মকর্তাদের আনুগত্যের প্রতীক হয়ে ওঠেন। একসময় যারা মানুষ গড়ার কারিগর ছিলেন, আজ তারা নিজেরাই ব্যবস্থার দাস।

শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধির প্রশ্নটি এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন শিক্ষক যদি আর্থিক অনটনে ভোগেন, তবে তিনি মনোযোগ দিয়ে শিক্ষা দিতে পারবেন না। বরং শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণে অধিক মনযোগী হবেন, প্রাইভেট পড়াবেন, কোচিং সেন্টার চালু করবেন, গাইড বইয়ের ব্যবসা করবেন, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দ থেকে অর্থ লোপাট করার মতো দুর্নীতিতে যুক্ত হবেন৷ সমাজে শিক্ষকের প্রতি সম্মান ফিরিয়ে আনার সবচেয়ে কার্যকর পথ হলো তাঁদের বেতনভাতা ও সুযোগ-সুবিধা উন্নত করা এবং তাদেরকে রাজনৈতিক গোলাম বানানো বন্ধ করা। প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার মর্যাদা যদি শিক্ষকেরা পান, তবে এ পেশা মেধাবীদের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।

বাঙলাদেশে প্রতিটি সরকারই শিক্ষানীতি সংস্কারের নামে বিকৃত করেছে। একদিকে বইপুস্তক নির্ভর, মুখস্থ নির্ভর শিক্ষা, অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অগণিত বাণিজ্য—সব মিলিয়ে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যটি হারিয়ে গেছে। শিক্ষা আর বিকশিত হবার উপায় নয়, এটি এখন কেবলই চাকরির প্রতিযোগিতার অস্ত্র। আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ক্রমশ কমছে। জাতীয় আয়ের মাত্র ২ শতাংশেরও কম ব্যয় করা হয় শিক্ষায়। অথচ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হলো অন্তত ৫–৬ শতাংশ। স্বাস্থ্য, পরিবহন, প্রতিরক্ষা খাতে যেভাবে বরাদ্দ বাড়ানো হয়, শিক্ষাকে তেমনি গুরুত্ব না দিলে জাতি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হারাবে।

এদেশে শিক্ষা আন্দোলন একসময় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে গর্জেছিল। আজ সেই শিক্ষা আন্দোলন কোথায়? শিক্ষক সংগঠনগুলো আজ প্রশাসনের অনুচর, শিক্ষার্থী সংগঠনগুলো আজ রাজনৈতিক অস্ত্র। জ্ঞানচর্চা নেই, কেবল পদলাভের প্রতিযোগিতা।

শিক্ষক দিবসে তাই শ্রদ্ধার ভাষার চেয়ে প্রতিবাদের ভাষাই অধিক প্রাসঙ্গিক। কারণ, শিক্ষককে শ্রদ্ধা করা মানে শিক্ষাকে রক্ষা করা। আর শিক্ষাকে রক্ষা করা মানে সত্যের পক্ষ নেওয়া, অন্ধ অনুসরণে না গিয়ে বোধের রাজনীতি তৈরি করা। শিক্ষকরা যদি আবার জ্ঞানের অন্বেষণে ফেরেন, যদি তারা শ্রেণিকক্ষকে প্রশাসনিক কক্ষ নয়, বরং মুক্ত চিন্তার মঞ্চে রূপান্তর করেন—তবেই বাঙলাদেশে শিক্ষা পুনর্জন্ম পাবে।

আজকের শিক্ষক দিবস তাই ফুল ও বক্তৃতার নয়, বিবেকের পুনর্জাগরণের দিন হওয়া উচিত। এই দিনে অঙ্গীকার হওয়া উচিত—শিক্ষাকে মুক্ত করব রাজনীতি, বাণিজ্য ও তোষণ থেকে। শিক্ষককে ফিরিয়ে দেব তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা—যিনি কেবল পাঠদানকারী নন, বরং সত্যের অনুসন্ধানী, সমাজবোধের নির্মাতা। শিক্ষা তখনই অর্থবহ, যখন তা মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শেখায়, প্রশ্ন করতে শেখায়, প্রতিরোধ করতে শেখায়। শিক্ষক দিবসের আসল উদযাপন সেখানেই—যেখানে শ্রেণিকক্ষ হয়ে ওঠে নতুন চিন্তার গবেষণাগার, আর শিক্ষক হয়ে ওঠেন আলোর অনমনীয় প্রহরী।

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *