❑ সাম্য রাইয়ান
ষাটের দশকের ঝঞ্ঝার মধ্যে জন্ম নেওয়া হাংরি আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি সুবিমল বসাক৷ কিন্তু তিনি কেবলমাত্র আন্দোলনের সীমায় আটকে না থেকে নিজের ভাষা ও ভঙ্গিমায় তৈরি করেছিলেন স্বতন্ত্র পরিচয়। বাঙলা কবিতার শরীরে তিনি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ঢাকাইয়া বুলির হালকা অথচ ঝলমলে মিশ্রণ, যা পাঠকের কানে হাসির মতো বাজে আবার বিদ্রূপের মতো খোঁচাও দেয়। এমনকি তাঁর গদ্যেও ছিল একই ঢঙ—ডানপিটে, তীক্ষ্ণ অথচ প্রাণবন্ত, যেন একেবারে রাস্তাঘাট থেকে উঠে আসা ভাষা।
কিন্তু শুধু কবি বললে সুবিমল বসাককে সীমাবদ্ধ করা হয়। তিনি ছিলেন চিত্রকরও, রেখার টানে যার হাত ছিল অসামান্য। তাঁর আঁকায় যে মায়া ফুটত, সেটি যেমন আলাদা, তেমনি তাঁর সাহিত্যচর্চা ছিল বহুমুখী। সতীনাথ ভাদুড়ীর ভাবশিষ্য ফণীশ্বরনাথ রেণুর সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক ছিল, আর রেণুর ‘ময়লা আঁচল’ উপন্যাসের বঙ্গানুবাদ করেছিলেন তিনি। অনেকেই জানেন না, সতীনাথ সমগ্র সম্পাদনার কাজেও ছিল তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। অর্থাৎ তিনি কেবল নিজের সৃষ্টির ভিতর দিয়ে নয়, অন্যের সৃষ্টিকেও নতুন পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে অগ্রণী ছিলেন।
হাংরি আন্দোলনের প্রসঙ্গে তাঁর অবস্থান ছিল কিছুটা আলাদা। অন্যরা যেখানে রাগ আর প্রতিরোধের তীব্রতায় মগ্ন, সেখানে তাঁর কবিতায় পাওয়া যেত খুনসুটি, রসিকতা, হালকা হাসি, আবার একইসঙ্গে জীবনযন্ত্রণার অদ্ভুত টান। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, বিদ্রোহ হাসতেও পারে, আঞ্চলিক বুলিকে কাব্যের উচ্চভাষায় বসিয়েও জেগে থাকতে পারে। ‘হাবিজাবি’ কাব্যগ্রন্থের পাতায় পাতায় এই ভঙ্গি ছড়িয়ে আছে। আমরা যারা পূর্ববঙ্গীয়, তাঁদের কাছে ঢাকাইয়া ভাষার টান এক অন্য আনন্দের উৎস ছিল, সুবিমল বসাক সেটিকে কবিতায় এনে এক নতুন অভিজ্ঞতা তৈরি করেছিলেন।
আমার কাছে সুবিমল বসাকের সবচেয়ে বড় অবদান হলো কবিতার উপাদানকে বিস্তৃত করার দুঃসাহস। আমরা আগে ভাবতাম কবিতা মানেই কাব্যিকতা, সুন্দর শব্দ, অলঙ্কার, সুশ্রী আবহ। কিন্তু সুবিমল বসাক দেখিয়ে দিলেন, কবিতা আসতে পারে টঙের দোকান থেকে, ফাটা চপ্পলের শব্দ থেকেও, এমনকি কথার মধ্যে ছুঁচ-সুতো, পেরেক-ইস্ক্রুও কবিতার শরীরে ঢুকে পড়তে পারে। হাংরিদের পুরো আন্দোলনের ভেতরই এই বদল ঘটেছিল, কিন্তু সুবিমল সেই বদলকে এমনভাবে জীবন্ত করে তুলেছিলেন যে তা হয়ে উঠেছিল মজা, খেলা আর প্রতিবাদ—সব মিলিয়ে এক নতুন ছন্দ।
তাঁর প্রয়াণ আমাদের মনে এক শূন্যতা রেখে গেছে। কিন্তু শূন্যতা মানেই নিস্তব্ধতা নয়। তাঁর ভাষা, তাঁর ঢাকাইয়া মেজাজ, তাঁর আঁকা রেখার খেলা, সবকিছুই আমাদের ভেতর বেঁচে আছে। যখনই আমরা ভাবি কবিতা মানেই কিছু আলাদা, কিছু উচ্চাঙ্গ, তখনই সুবিমল বসাক ফিরে আসেন মনে করিয়ে দিতে—কবিতা মানে জীবন, কবিতা মানে প্রতিদিনের ভাষাকে নতুন চোখে দেখা। কাব্যিকতা উবে গেলে ভয় নেই, কারণ কবিতা আসবে নতুন চেহারায়, ভাঙাচোরা বাস্তব থেকে, মানুষের কথোপকথন থেকে।
কবিতা আসলে আমাদের বেঁচে থাকারই এক অদম্য ঘোষণা।