ক্যামেরার আড়ালে এক অন্তরঙ্গ দার্শনিক

❑ সাম্য রাইয়ান

আমার মনে হয়, ঋতুপর্ণ ঘোষের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো—তিনি দর্শকের অভ্যন্তরীণ অনুভূতি স্পর্শ করতে পেরেছিলেন। ক্যামেরার ভাষা, আলো-ছায়ার ব্যবহার, চরিত্রদের কথোপকথনের নিরাসক্ত অথচ মর্মস্পর্শী সুর—এসব মিলে এক অদ্ভুত অন্তরঙ্গ পরিবেশ তৈরি করতেন। দর্শক সেই পরিবেশের ভেতরে ঢুকে পড়ে নিজেকে আবিষ্কারের অবকাশ পেত।

বাঙলা সিনেমার মূলধারার অভ্যন্তরে যখন বেশিরভাগই বাণিজ্যিক মেলোড্রামার পুনরাবৃত্তি চলছিল, সেই সময় তিনি সাহসীভাবে ভিন্ন এক ভাষা তৈরি করলেন—যেখানে বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের অন্তর্দন্দ্ব, সম্পর্কের টানাপোড়েন, যৌনতা, লিঙ্গ-পরিচয়ের সংকট সবকিছুই একইসাথে উঠে আসে।

তাঁর সিনেমার বর্ণনাভঙ্গি এমনই অনন্য, যেখানে গল্প শুধু দৃশ্য নয়, মানুষের অন্তর্গত অনুভূতির ভাষায় প্রকাশ পায়। উনিশে এপ্রিল থেকে শুরু করে চোখের বালি, দোসর কিংবা শুভ মহরৎ—প্রতিটি চলচ্চিত্রে তিনি চরিত্রদের ভেতরের ভাঙনকে এমনভাবে উন্মোচন করেন যে, দর্শক মনে করে এই ভাঙন আসলে আমাদের নিজেদের। তিনি সম্পর্ককে কখনো সরল রেখায় আঁকেননি; বরং দ্বন্দ্ব, ঈর্ষা, ভালোবাসা, অভিমান, সামাজিক চাপ—সব মিলিয়ে সম্পর্ককে এক জীবন্ত মানচিত্রে রূপ দিয়েছেন।

ঋতুপর্ণ ঘোষের সাহিত্যকর্ম, বিশেষত তাঁর প্রবন্ধ ও আত্মজৈবনিক লেখা, তাঁর দর্শনের আরেকটি দিক প্রকাশ করে। তাঁর কলমে যেমন দেখা যায় বাঙালি সংস্কৃতির উত্তরাধিকারের টানাপোড়েন, তেমনই ব্যক্তিগত সাহস—নিজের লিঙ্গপরিচয় নিয়ে খোলামেলা স্বীকারোক্তি, সমাজের কপটতা ভাঙার প্রচেষ্টা। তিনি জানতেন, শিল্প মানে নিছক নন্দনবোধ নয়, বরং একধরনের অবস্থান নেওয়া। আর এ অবস্থান সমাজের প্রচলিত প্রবাহে অস্বস্তি তৈরি করে৷ একারনেই তিনি বলেন, “আমি জানি আমার শহর আমায় নিতেও পারবে না ফেলতেও পারবে না৷”

ঋতুপর্ণের দর্শন মূলত মানবিকতার দর্শন। তিনি চাইতেন মানুষ নিজেকে মুক্ত করে তুলুক সমাজের আরোপিত বাঁধন থেকে। বিশেষ করে লিঙ্গ ও যৌনতার বিষয়ে তাঁর অবস্থান ছিল রাজনৈতিকও। তিনি প্রায় একাই গোটা বাঙলায় ‘কুইয়ার’ পরিচয়ের স্বীকৃতির লড়াইকে শিল্পের মূলধারায় টেনে আনেন। তাঁর শেষ দিকের ছবি—আরেকটি প্রেমের গল্প, চিত্রাঙ্গদা—এই জায়গায় একেবারেই ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। এগুলো শুধু সিনেমা নয়, বরং ঘোষণা—মানুষের স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকারের ঘোষণা।

তবে তাঁর কাজ নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে বিস্তর। অনেকেই বলেছেন, ঋতুপর্ণ কখনো কখনো অতিরিক্ত মেলোড্রামাটিক হয়ে যান, বা তাঁর সিনেমা শহুরে মধ্যবিত্তের সঙ্কীর্ণ জগৎকে ঘিরে আবর্তিত। এই সমালোচনাগুলো হয়তো পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এটাও ঠিক যে, তিনি সচেতনভাবেই সেই জগতকে বেছে নিয়েছিলেন, কারণ সেখান থেকেই তিনি প্রশ্ন তুলতে পারতেন সমাজের ভেতরের লুকোনো ভণ্ডামি সম্পর্কে। তিনি ভাষ্য, “সেন্সরের ভয়, সমাজের ভ্রুকুটি-এসবের ফাঁক গলে গল্প বলি। চরিত্রগুলোকে এমন জায়গায় দাঁড় করাই, যেখানে তারা ‘নিয়ম’ ভাঙে না; বরং নিয়মের অমানবিকতাকে ফাঁস করে। শিল্প যদি কারও ক্ষত ঢাকে, তবে সেটি স্রেফ প্রসাধন। আমি চাই, শিল্প ক্ষত দেখাক-আর দেখানোর মাধ্যমেই সান্ত্বনা দিক।”

ঋতুপর্ণ ঘোষ শিল্পের মাধ্যমে জীবনের বহুমুখী সত্যকে ধরতে চেয়েছিলেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, শিল্প কেবল বিনোদন নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের অপরিহার্য অংশ।

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *