পাহাড়ে ধর্ষণ, রাষ্ট্রের নীরবতা ও আমাদের নৈতিক পতন

❑ সাম্য রাইয়ান

খাগড়াছড়ির সিঙ্গিনালায় অষ্টম শ্রেণির এক আদিবাসী কিশোরীকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে। এই ঘটনাটি পাহাড়ে দীর্ঘদিন ধরে চলমান দমননীতি, নৃশংসতা ও ন্যায়বিচারের অভাবের আরেকটি ভয়াবহ দৃষ্টান্ত। কিন্তু এই ঘটনার ভয়াবহতাকে ছাপিয়ে গেছে যে বিষয়টি—তা হলো, ধর্ষণের বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের উপর সেনাবাহিনী ও সেটলার বাঙালিদের যৌথ হামলা। তাহলে বিষয়টি দাঁড়াল এই যে—ধর্ষণ নয়, বরং ধর্ষণ-বিরোধী প্রতিবাদই আজ রাষ্ট্রের চোখে অপরাধ। এই ঘটনা শুধু একটি কিশোরীর প্রতি বর্বরতা নয়, এটি আমাদের রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার মৃত্যু।

বাঙলাদেশের সংবিধান বলে, সবাই সমান অধিকারভোগী। কিন্তু পাহাড়ে গিয়ে সেই বাক্যটি এক নির্মম ঠাট্টায় পরিণত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী নারী যখন ধর্ষিত হন, তখন তিনি শুধু এক ব্যক্তি হিসেবে নয়—একটি জাতিগোষ্ঠীর প্রতীক হিসেবে অপমানিত হন। তার শরীরে যে নির্যাতন চালানো হয়, তা মূলত রাষ্ট্রের দখলদারিত্বের ভাষায় প্রকাশিত সহিংসতা। এই ধর্ষণগুলো কেবল যৌন অপরাধ নয়, এটি রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রকাশ। পাহাড়ে নারীদেহ দীর্ঘদিন ধরে কি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে—যেখানে অস্ত্রের জায়গায় ব্যবহৃত হয় ক্ষমতার দম্ভ, প্রশাসনের পক্ষপাত, এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তাহীনতা?

পাহাড়ে ধর্ষণ নতুন নয়। কিন্তু বিচার? নেই। কেউ শাস্তি পায় না। বরং দেখা যায়, প্রশাসন ঘটনাকে আড়াল করতে উঠে পড়ে লাগে, গণমাধ্যমে খবর চাপা পড়ে যায়, তদন্তে বিলম্ব হয়, আর শেষে ‘অপরাধী অজ্ঞাত’—এই বাক্যে সবকিছু মিশে যায়। এই ‘অজ্ঞাত’ আসলে কারা? তারা কি পাহাড়ের আড়ালে বসবাসরত কোনো প্রেতাত্মা? না, তারা খুবই চেনা মানুষ—রাষ্ট্রীয় ছত্রছায়ায় বেঁচে থাকা, অপরাধে অভ্যস্ত, দণ্ডমুক্তির সংস্কৃতিতে গা ভাসানো এক শ্রেণি।

এই দণ্ডমুক্তির সংস্কৃতি আমাদের রাষ্ট্রীয় চেতনারই অংশ হয়ে গেছে। ধর্ষণ যেন আর অপরাধ নয়, বরং প্রশাসনিক রুটিনের একটি অংশ। পাহাড়ে ধর্ষণ ঘটে—অভিযোগ ওঠে—প্রতিবাদ হয়—হামলা হয়—তারপর রাষ্ট্র চুপ থাকে। এই চক্রটি এক ভয়ঙ্কর নৈরাশ্য তৈরি করেছে, যেখানে পাহাড়ি মানুষ ন্যায়বিচারের সম্ভাবনা হারিয়ে ফেলেছে।

২৩ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর খাগড়াছড়ির রাস্তায় যেভাবে শিক্ষার্থীরা, সাধারণ মানুষ, স্থানীয় সংগঠন প্রতিবাদে নেমেছিল—সেটা ছিল পাহাড়ের ইতিহাসে এক সাহসী মুহূর্ত। কিন্তু সেই প্রতিবাদের উপর হামলা চালিয়েছে সেনাবাহিনী ও সেটলাররা। এই আক্রমণ শুধু একটি জনসমাবেশ ভাঙেনি, এটি পাহাড়ের মানুষের হৃদয়ে নতুন করে গেঁথে দিয়েছে সেই পুরনো ভয়—‘পাহাড়ে ন্যায়বিচারের কথা বলা যাবে না।’

পাহাড়ে সেনাবাহিনী থাকার উদ্দেশ্য কী? সেনাশাসন কি পাহাড়ের শান্তির নিশ্চয়তা দিয়েছে, না কি তা বরং পাহাড়কে এক স্থায়ী কারাগারে পরিণত করেছে? পার্বত্য শান্তি চুক্তির পরও কেন এখনো পাহাড়ে এত সেনাক্যাম্প, এত টহল, এত নজরদারি? পাহাড়ে সেনাবাহিনীর অবস্থান এখন শান্তির নয়, একধরনের উপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণের প্রতীক। তারা সেখানে পাহাড়িদের রক্ষা করতে নয়, বরং পাহাড়কে নজরবন্দি রেখেছে।

এই উপনিবেশিক মনোভাবই পাহাড়ের প্রতিটি ধর্ষণের পেছনে কাজ করে। ধর্ষণকে আমরা বারবার দেখি একক অপরাধ হিসেবে, কিন্তু পাহাড়ের ধর্ষণগুলো আসলে রাজনৈতিক অপরাধ। এগুলোর পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের দখলনীতি, বৈষম্য, সামরিকীকরণ, এবং বাঙালি সেটলারদের স্থায়ী প্রভাব। পাহাড়ে যখন কোনো কিশোরী ধর্ষিত হয়, তখন তার চিৎকার কেবল তার নয়, একটি গোটা জাতিগোষ্ঠীর আর্তনাদ হয়ে ওঠে। কিন্তু রাষ্ট্র তা শোনে না। প্রশাসন তখন ব্যস্ত থাকে “আইনি প্রক্রিয়া চলছে” এই মুখস্থ কথায়।

যেন একটি স্বাধীন বাঙলাদেশের ভেতরে আরেকটি পরাধীন বাঙলাদেশ।

এই বিচ্ছিন্নতা, এই উদাসীনতাই পাহাড়ে অন্যায়কে স্থায়ী করে তুলেছে। রাষ্ট্রের নিরবতা আজ ধর্ষণের অন্যতম সহায়। প্রশাসন যখন কোনো অপরাধীকে রক্ষা করে, যখন কোনো ধর্ষণ মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকে, তখন রাষ্ট্র আসলে নিজেই ধর্ষকের পক্ষে দাঁড়ায়। 

ধর্ষণের বিচারহীনতা কোনো দুর্ঘটনা নয়; এটি রাজনৈতিক পরিকল্পনা। ধর্ষণ পাহাড়ে এক ধরনের সামাজিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি ভীতির জন্ম দেয়, প্রতিবাদকে স্তব্ধ করে, এবং আদিবাসী নারীর দেহকে রাষ্ট্রীয় আধিপত্যের ভাষায় পরিণত করে।

একটি কিশোরীর শরীরের উপর দিয়ে চলে যায় জাতিগত নিপীড়নের ইতিহাস—তার আর্তনাদে মিশে থাকে শতাব্দীর অন্যায়।

পাহাড়ে যে মেয়েটি ধর্ষিত হলো, সে হয়তো এখন হাসপাতালে শুয়ে আছে—শরীরে অসহ্য ব্যথা, চোখ আতঙ্কে নীরব। তার নীরবতা বাধ্যতামূলক, কারণ এই সমাজে ধর্ষিত নারী এখনো লজ্জার প্রতীক, আর ধর্ষক ক্ষমতার প্রতীক।

রাষ্ট্র যদি সত্যিই পাহাড়ের প্রতি দায়বদ্ধ হতো, তাহলে এই ঘটনাটি আজ জাতির আলোচনার কেন্দ্রে থাকত। কিন্তু রাষ্ট্র নীরব। উপদেষ্টাদের মুখে আলোচনা নেই, সরকারি পার্টি ও নেতাদের কণ্ঠে প্রতিবাদ নেই, গণমাধ্যমের বেশিরভাগই চুপ। এই নীরবতাই প্রমাণ করে—ধর্ষণের সংস্কৃতি এখন রাষ্ট্রেরই অংশ।

পাহাড় থেকে সেনাশাসন প্রত্যাহার না করলে, পার্বত্য চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন না করলে, পাহাড়ে ন্যায়বিচার কখনো সম্ভব নয়। পাহাড়ের মানুষের অধিকার মানে কেবল জমির অধিকার নয়—এটি জীবন, মর্যাদা, নিরাপত্তা ও আত্মমর্যাদার প্রশ্ন।

আমরা দাবি জানাই—
১. খাগড়াছড়ির ধর্ষণে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
২. ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে হামলাকারী সেনাসদস্য ও সেটলারদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
৩. আহতদের চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে।
৪. পাহাড়ে সেনাশাসন প্রত্যাহার ও পার্বত্য শান্তিচুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।
৫. পাহাড়ে সংঘটিত সকল ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনায় একটি স্বতন্ত্র তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে, যাতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীও জবাবদিহির আওতায় আসে।

একটি রাষ্ট্র তখনই সভ্য হয়, যখন সে তার সবচেয়ে দুর্বল নাগরিকের পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু আমরা আজ এমন এক রাষ্ট্রে বাস করছি, যেখানে দুর্বলকে চেপে ধরা হয়, প্রতিবাদীকে দমন করা হয়, আর অপরাধীকে রক্ষা করা হয়।

পাহাড়ের কিশোরীর চোখে আজ পুরো বাঙলাদেশের প্রতিচ্ছবি। তার অশ্রুতে ধুয়ে যাচ্ছে আমাদের সভ্যতার মুখ। আমরা যারা সমতলে বসে নীরব থাকছি, আমরা এই অপরাধের অংশ। কারণ নীরবতা মানে সম্মতি।

খাগড়াছড়ির সেই মেয়েটি আজ শুধু পাহাড়ের নয়, সে বাঙলাদেশের বিবেকের কন্যা। তার আর্তনাদ আমাদের সকলের ঘুম ভাঙিয়ে দিক—যাতে একদিন এই রাষ্ট্র তার কন্যাদের রক্ষা করতে শেখে, পাহাড়ে আবার শান্তি নামে, আর ধর্ষণ আর কখনো কোনো জাতির রাজনীতি না হয়।

রাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দিতে চাই—
একটি কিশোরীর কান্না পাহাড়ে পড়ে থাকে না,
তা প্রতিধ্বনি হয়ে একদিন সমতলেও আঘাত হানে।
যে রাষ্ট্র তার কন্যাদের রক্ষা করতে পারে না,
সে রাষ্ট্রের পতাকা যতই দিকে দিকে উড়ুক না কেন—তার নীচে কেবল লজ্জা, রক্ত আর ধর্ষণের গন্ধ।

২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *