❑ সাম্য রাইয়ান
বাঙলাদেশের সাংস্কৃতিক কল্পচিত্র থেকে ফেব্রুয়ারি মাসকে বাদ দিয়ে দেখা যায় না। ফেব্রুয়ারির ভোর মানে শহীদ মিনারের পাদদেশে হাজারো কণ্ঠে গান— ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’। ফেব্রুয়ারির বাতাসে আজও শোনা যায় রক্তঝরা পদধ্বনি, ফুলে ভরে ওঠে মিনার, শহীদের স্মৃতি মিলেমিশে যায় বর্তমানের শীতল সকাল আর উত্তাল বিকেলের সাথে। ফেব্রুয়ারি মানে প্রতীকী পুনর্জন্ম—এটি ভাষার, সংস্কৃতির, চেতনার মাস। এই ফেব্রুয়ারির বুকেই জন্ম নিয়েছিল অমর একুশে বইমেলা, যেটি আজ কেবল একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নয়, হয়ে উঠেছে জাতির আত্মপরিচয়ের অন্যতম দ্যোতক।
কিন্তু বাংলা একাডেমি হঠাৎ ঘোষণা করেছে, ২০২৬ সালের বইমেলা ফেব্রুয়ারি মাসে নয়, শুরু হবে ২০২৫-এর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি এবং শেষ হবে ২০২৬-এর জানুয়ারিতে। সরকারি যুক্তি—ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং রমজান মাস। শুনতে যুক্তিসঙ্গত মনে হলেও এর ভেতরে লুকিয়ে আছে সাংস্কৃতিক আত্মসমর্পণের এক কুৎসিত ছায়া।
প্রথমে নির্বাচন প্রসঙ্গ। ইতিহাস সাক্ষী, তিনবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হয়েছে—১৯৭৯, ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালে। অথচ বইমেলার সময় পাল্টাতে হয়নি। নির্বাচনের দিন ছুটি হওয়ায় অনেকেই ভোট দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে বইমেলায় গিয়েছেন, ভিড় বরং বেড়েছে। তাহলে কেন এইবার হঠাৎ ভোটের অজুহাত? নির্বাচনের কারণে বইমেলায় ভিড় কমে যাবে—এমন ধারণা বাস্তব অভিজ্ঞতায় ভিত্তিহীন। আসলে এই সিদ্ধান্তের আড়ালে রয়েছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অযৌক্তিক কর্তৃত্ব এবং মৌলবাদের চাপ, যা ধীরে ধীরে বাঙলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবনকে গ্রাস করছে। মনে হয় যেন বইমেলাকে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের অধীনস্থ করার এক মানসিকতা কাজ করছে—যেখানে সংস্কৃতি আর ইতিহাসের স্বাধীনতা কোনো গুরুত্ব বহন করে না।
বাংলা একাডেমি দ্বিতীয় যে অজুহাত দিয়েছে, তা হলো রমজান মাস। বলা হচ্ছে, রোজার মাসে বইমেলা চলতে পারে না। কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায়, এটা একধরনের আত্মসমর্পণ ছাড়া কিছু নয়। সন্ধ্যার পর ইফতার শেষে মেলায় ভিড় বাড়তে পারত, মানুষ পরিবার নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারত, ইফতারের পর বইমেলার পরিবেশ ভিন্ন মাত্রা পেত। অথচ এই সম্ভাবনাকে আঁকড়ে না ধরে বাংলা একাডেমি মৌলবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। ইতোমধ্যে প্রমাণিত, মেলায় অস্থায়ী মসজিদ থাকে, নামাজের ব্যবস্থাও থাকে। তাহলে কেন এই ভীতসন্ত্রস্ত মনোভাব? স্পষ্টতই মৌলবাদের প্রতি একরকম তুষ্টির নীতি কাজ করছে। এটি কেবল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়; একপ্রকার সাংস্কৃতিক পরাজয়ও।
একটু ফিরে দেখা যাক। ষাটের দশকে চট্টগ্রামে ছোট আকারে বইয়ের মেলা হতো, ঢাকায় বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে লেখক ও পাঠকের মিলনমেলা তৈরি হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাঙলাদেশে বইমেলা প্রকৃত রূপ নেয়। ১৯৭২ সালের পর থেকে এটি ধীরে ধীরে একুশের মাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। আশির দশকে বইমেলা শুধু বই বিক্রির জায়গা থাকেনি, হয়ে উঠেছে মত প্রকাশের ক্ষেত্র, রাজনৈতিক প্রতিরোধের জায়গা। সেনাশাসনের বিরুদ্ধে লেখক-পাঠক-শিল্পীরা বইমেলাকে ব্যবহার করেছেন প্রতীকী প্রতিবাদের মঞ্চ হিসেবে। স্বাধীনতার পর বইমেলা হয়ে উঠেছে শহীদ মিনারের এক সম্প্রসারণ—যেখানে বই মানে প্রতিরোধ, বই মানে স্বাধীন চিন্তা। ফেব্রুয়ারির মাটিতে দাঁড়িয়ে বইমেলা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শহীদদের রক্তে লেখা এই ভাষার উত্তরাধিকার বইয়ের ভেতরেই জীবন্ত।
ফেব্রুয়ারি মাসের সাথে বইমেলার প্রতীকী সম্পর্কের প্রশ্ন এখানে মুখ্য। তাহলে বইমেলাকে ফেব্রুয়ারি থেকে সরিয়ে নিলে কী হারাব আমরা? একুশের শহীদ স্মৃতির আবহে বইমেলার অর্থ দাঁড়ায় ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। একে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে সরিয়ে নিলে তা হয়তো প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ভালো হবে, কিন্তু সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এটি হবে আত্মবিরোধী, আমরা হারাব সেই প্রতীকী সংযোগ, হারাব শহীদদের সাথে সাংস্কৃতিক যোগসূত্র। বইমেলা হয়ে উঠবে শুধু কাগজ আর কালি বিক্রির বাজার। অমর একুশে বইমেলা কেবল একটি তারিখ নয়, এটি ইতিহাস, এটি প্রতীক, এটি সংগ্রামের উত্তরাধিকার। ফেব্রুয়ারি না থাকলে বইমেলার বুক থেকে ইতিহাস বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি ভয়াবহ—প্রজন্মের পর প্রজন্ম বইমেলাকে কেবল বাণিজ্যিক মেলা ভেবে বড় হবে, তারা আর জানবে না যে ফেব্রুয়ারি মানেই মাতৃভাষার আন্দোলন, শহীদ মিনার, আর বইমেলা একসাথে মিলে এক চেতনার নাম।
আজ যে বাঙলাদেশে মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তার প্রভাব পড়ছে সব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের উপর। বাংলা একাডেমি ও বইমেলাও এর বাইরে নয়। একসময় একাডেমি ছিল মুক্তচিন্তার প্রতীক, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করা জায়গা। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটি প্রশাসনিক অজুহাতের আড়ালে মৌলবাদের তুষ্টিতে লিপ্ত। এটা কি কেবল কাকতালীয়? না, এর পেছনে একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রবণতা কাজ করছে—যেখানে মৌলবাদীরা চায় সাংস্কৃতিক পরিসর সংকুচিত হোক, মানুষ বই থেকে দূরে সরে যাক, মুক্তচিন্তার জায়গা ধ্বংস হোক। তারা সবসময় চেয়েছে মানুষকে বই থেকে বিচ্ছিন্ন করতে, জ্ঞান ও সাহিত্য থেকে সরিয়ে নিতে। কারণ, বই মানুষের চিন্তাশক্তি জাগায়, প্রশ্ন করতে শেখায়, স্বাধীনভাবে ভাবতে শেখায়। মৌলবাদ কখনোই প্রশ্ন পছন্দ করে না; তারা চায় অন্ধ অনুসরণ, চায় চিন্তার বদলে আনুগত্য। তাই বইমেলা দুর্বল করা তাদের পক্ষে সবচেয়ে কার্যকর কৌশল। যদি মানুষ বইমেলা থেকে দূরে সরে যায়, যদি ফেব্রুয়ারির প্রতীকময় সম্পর্ক ভেঙে যায়, তবে মৌলবাদের জয় অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাদের জন্য এটি সাংস্কৃতিক পরিসর খালি করার এক সুযোগ। বাংলা একাডেমির সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে এটি স্পষ্ট যে, মৌলবাদের প্রতি তুষ্টির নীতিই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে।
কেউ কেউ হয়তো বলবেন, বইমেলা অন্য মাসে হলেও কী আসে যায়? বই তো থাকবেই, পাঠক চাইলে আসবেন। কিন্তু সাংস্কৃতিক প্রতীকী অর্থকে অবহেলা করলে তার দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি অগাধ। একুশে ফেব্রুয়ারির আবহের সাথে বইমেলার এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক আছে। ফেব্রুয়ারি আমাদের ইতিহাসে শোক, সংগ্রাম ও গৌরবের মাস। এই মাসেই বইমেলা মানুষকে বইয়ের মাধ্যমে ইতিহাসের সাথে যুক্ত করে, শহীদদের স্মৃতির সাথে নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দেয়। এই যোগসূত্র ভেঙে গেলে বইমেলা হয়ে উঠবে কেবল একটি ব্যবসায়িক মেলা, ইতিহাসবিচ্ছিন্ন, আত্মাহীন।
দীর্ঘমেয়াদে এর ফল কী হতে পারে? প্রথমত, সাংস্কৃতিক চেতনার ধারাবাহিকতা ভেঙে যাবে। বইমেলা আর একুশের প্রতীক হয়ে থাকবে না। দ্বিতীয়ত, পাঠকপ্রজন্ম বইয়ের সাথে ইতিহাসের যোগসূত্র হারাবে। তৃতীয়ত, মৌলবাদীরা সাংস্কৃতিক পরিসর খালি করার সুযোগ পাবে। চতুর্থত, বাংলা একাডেমি তার ঐতিহাসিক ভূমিকা হারিয়ে কেবল একটি প্রশাসনিক অফিসে পরিণত হবে।
বইমেলার শক্তি সবসময় ছিল পাঠক ও লেখক। কিন্তু এবার লেখক-পাঠক-প্রকাশক, দৃশ্যত সকলের মতকে অগ্রাহ্য করে বইমেলার তারিখ নির্ধারণের মধ্য দিয়ে এই সাংস্কৃতিক শক্তিকে দুর্বল করার অর্থ হলো দীর্ঘমেয়াদে পুরো জাতিকে ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করা। বইমেলা ফেব্রুয়ারি ছাড়া হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধীরে ধীরে ভুলে যাবে কেন বইমেলা একুশের সাথে যুক্ত ছিল। তাদের কাছে বই হবে কেবল ব্যবসা, আর মেলা হবে কেবল উৎসব—এর ভেতরে আর থাকবে না সংগ্রামের উত্তরাধিকার। এটি শুধু ক্ষতি নয়, এটি সাংস্কৃতিক বিপর্যয়।
বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস প্রমাণ করে, মৌলবাদকে তুষ্টি করে টিকে থাকা যায় না। মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, গণতন্ত্রের লড়াই—সবকিছুতে মৌলবাদ ছিল প্রতিপক্ষ। আজ আবার সেই প্রতিপক্ষ সাংস্কৃতিক মঞ্চে প্রবেশ করেছে, আর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করছে। বাংলা একাডেমি যদি সত্যিই বইমেলাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে চায়, তবে তার দরকার হবে মৌলবাদের ভয়ে না থেকে বই প্রকাশনা ও বিপণনকে সুশৃঙ্খল করা, লেখক-পাঠকের পারস্পরিক বিনিময়ের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করা, সাহিত্যচর্চাকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তোলা। প্রশাসনিক সুবিধার অজুহাত দেখিয়ে বইমেলার সময় সরিয়ে দেওয়া সমাধান নয়। বরং এটি প্রমাণ করে, প্রতিষ্ঠানটি তার সাংস্কৃতিক দায়িত্ববোধের চেয়ে প্রশাসনিক সুবিধাবাদিতাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এটি সেই আত্মবিরোধী সিদ্ধান্ত, যা কেবল প্রশাসনিক সুবিধার জন্য নয়, মৌলবাদের জন্য পথ প্রশস্ত করার জন্যও নেওয়া হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল—বাঙলাদেশ কি সত্যিই এই পথে যাবে? ফেব্রুয়ারির বইমেলা হারানো মানে শুধু একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হারানো নয়; এর অর্থ জাতির আত্মপরিচয়ের টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া। শহীদ মিনারের ফুল শুকিয়ে গেলে যেমন আমাদের বুক খালি লাগে, ফেব্রুয়ারি ছাড়া বইমেলা হলে তেমনই আত্মা খালি হয়ে যাবে।
অতএব এখনো সময় আছে—বাংলা একাডেমি চাইলে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে পারে। বইমেলার মূল শক্তি পাঠক ও লেখক; তাঁদের ইচ্ছা ও অংশগ্রহণকেই সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ফেব্রুয়ারি ছাড়া একুশে বইমেলা কল্পনা করা যায় না। এটি কেবল অগ্রহণযোগ্য নয়, সাংস্কৃতিকভাবে আত্মঘাতীও।
ফেব্রুয়ারি আমাদের কাছে শুধু একটি মাস নয়; এটি প্রতিরোধ, ভাষা, আত্মত্যাগ ও সৃষ্টির প্রতীক। একুশে বইমেলা সেই প্রতীকেরই সাংস্কৃতিক রূপায়ণ। ফেব্রুয়ারি ছাড়া বইমেলা মানে আত্মপরিচয়ের বিপর্যয়, ইতিহাসের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, এবং মৌলবাদের হাতে সাংস্কৃতিক পরাজয়।
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখ দৈনিক দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত৷