যে লেখক পুরস্কার নয়, প্রতিবাদকে বেছে নিয়েছিলেন

❑ সাম্য রাইয়ান

গতকাল সন্ধ্যায় এক বন্ধু ফোনে জানালেন—সোনালা ইব্রাহিম [২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৭—১৩ আগস্ট ২০২৫] মারা গেছেন। বয়স হয়েছিল অষ্টআশি। খবরটা শুনেই মনে পড়ে গেল সেই বহুল আলোচিত ২০০৩ সালের কায়রো অপেরা হাউসের ঘটনা, যা আজও আরবি সাহিত্যচর্চার ভেতরে-বাইরে এক রকম প্রতীক হয়ে আছে। আমরা জানি, জীবদ্দশায় অনেক লেখক নানা পুরস্কার পান, গ্রহণ করেন, বক্তৃতা দেন। কিন্তু খুব কম জনই আছেন, যারা সেই সুযোগকেই রাষ্ট্রের মুখোশ খুলে দেওয়ার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। সোনালা ইব্রাহিম ছিলেন তাদেরই একজন।

সে বছর সরকার তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছিল আরবি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে। উপস্থিত ছিল তাবড় তাবড় মন্ত্রী, সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা, আলো ঝলমলে সেলিব্রিটি সমাজ। যখন নাম ঘোষণা করা হলো, হাততালিতে গর্জে উঠল পুরো অপেরা হাউস। কিন্তু যিনি মঞ্চে উঠলেন, তাঁর চোখে-মুখে কোথাও কৃতজ্ঞতার হাসি নেই—বরং কণ্ঠে ছিল রুদ্ধ কষ্ট আর প্রতিবাদের দৃঢ়তা। হাতে মাইক নিয়ে তিনি বলেছিলেন—
“…আমাদের নাটক সিনেমা সাহিত্য গল্প-উপন্যাস থেকে শুরু করে বৈজ্ঞানিক গবেষণা কিংবা শিক্ষা বিদ্যাচর্চা সবই গিয়েছে। বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে। ... সরকার বলতে যা, তা হলো একগুচ্ছ মেলা-খেলা-মোচ্ছব আর মিথ্যার সমষ্টি। আর সীমাহীন দুর্নীতি। … দেশের সমগ্র রাজনৈতিক ব্যবস্থা মানুষকে দাবিয়ে রাখার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ... দেশের মানুষের কাছে এই সরকারের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।...”

পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের এই ঘোষণার পর অপেরা হাউসে যে নীরবতা নেমে এসেছিল, তা বিস্ফোরণের চেয়ে কম কিছু নয়। মন্ত্রী-আমলা থেকে শুরু করে সাহিত্যিক-সেলিব্রিটি সবাই বুঝেছিলেন, এখানে সাহসের সংজ্ঞা রচিত হলো। পরবর্তীকালে ঘটনাটি “অপেরা ইনসিডেন্ট” নামে সাহিত্য ইতিহাসে জায়গা করে নেয়।

সোনালা ইব্রাহিমের জীবন যেন একেবারেই তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রতিচ্ছবি। তিনি একসময় কারাবন্দি ছিলেন, রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের গুলাগ-বন্দি সাহিত্য পড়তেন, নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে রূপ দিতেন উপন্যাসে। তাঁর প্রথম বড় কাজ That Smell (Tilka al-Ra’iha, 1966)—যা সেন্সরের কারণে বিকৃত রূপে প্রকাশিত হয়, কিন্তু তাতেও কায়রোর পরাজিত এক প্রজন্মের বাস্তবতা তীব্রভাবে ফুটে ওঠে। The Committee (Al-Lajna, 1981)-তে দেখা যায় অদৃশ্য এক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে এক নাগরিকের টিকে থাকার সংগ্রাম, যা নিছক রাজনৈতিক রূপক নয়—বরং আরব জগতের বাস্তবের শ্লেষ। আবার Zaat (1992)-এ তিনি এক নারী সাংবাদিকের জীবনকাহিনি দিয়ে গোটা মিশরীয় সমাজের দুর্নীতি, ধর্মীয় ভণ্ডামি, আর টালমাটাল অর্থনৈতিক পরিসরকে ব্যঙ্গ করেছেন।

সোনালা ইব্রাহিমের ভাষা ছিল কঠোর, প্রায় কাটা-কাটা, শুষ্ক রিপোর্টের মতো। কিন্তু সেই শুষ্কতার মধ্যেই থাকত পাঠককে আন্দোলিত করার মতো বিদ্রোহী স্পন্দন।

ইব্রাহিমের লেখায় বারবার উঠে এসেছে রাষ্ট্রের মিথ্যাচার, দুর্নীতি, দমননীতি—এবং এর ভেতর আটকে থাকা সাধারণ মানুষের অসহায়তা। নিজের লেখনী এবং ব্যক্তিগত অবস্থান দুই দিয়েই দেখিয়ে দিয়েছেন—সাহিত্য কেবল সৌন্দর্যের উৎসব নয়, বরং সত্য বলার দায়।

বাঙলা ভাষার পাঠকমহলে আমরা তাঁকে চিনতেই পারিনি। হয়তো সমকালীন ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধ সমালোচনা আড়াল করেছে তাঁর সাহিত্যকে। হয়তো অনুবাদের অভাবই আমাদের চোখ থেকে তাঁকে দূরত্বে রেখেছে। অথচ এ পৃথিবীতে যেখানে লেখকরা রাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করতে ব্যস্ত, সেখানে সোনালা ইব্রাহিম দেখিয়েছেন—একজন ঔপন্যাসিক রাষ্ট্রকে আঙুল তুলতে পারেন, কণ্ঠে ঝড় তুলতে পারেন, এমনকি পুরস্কারের চকচকে আলোকও প্রত্যাখ্যান করতে পারেন।

আমাদের সাহিত্য জগৎ যদি তাঁকে যথাযথভাবে স্মরণ না-ও করে, তাতে তাঁর গুরুত্ব কমে না। শুধু প্রশ্ন জাগে—আমরা কি আসলেই বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে তাল মেলাতে চাই, নাকি কেবল নিজস্ব পরিসরের মেলানকোলি আর আত্মতুষ্টি আঁকড়ে থাকতে চাই?

দিনহীনের দিনলিপি : ১৫ই আগস্ট ২০২৫

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *