❑ সাম্য রাইয়ান
আমার মনে হয় সুলতানের ছবির সবচেয়ে বিপ্লবী দিক হলো—তিনি দুর্বলতার শিল্প করেননি৷ কৃষক-মুটে-মজুরের অন্তর্গত শক্তির দিকে নজর দিতে পেরেছিলেন বলেই অন্যদের মতো কৃষিকে romanticize না করে glorify করেছেন।
এবং এই glorification এর পেছনে আছে একটা রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা: গ্রামীণ বাঙলাকে কেউ তুচ্ছ করে দেখবে না, কারণ গ্রামীণ মানুষরাই এই সভ্যতার প্রকৃত ভিত্তি।
ছবির পেশিশক্তি সুলতানের ভাষায় শরীরের সৌন্দর্য নয়, এক ধরনের নৈতিক শক্তি—aesthetic of labor।
ক্যানভাসে কৃষকের ঘাম এঁকে বাঙলার দারিদ্র্যকে আশ্চর্য মহিমায় রূপান্তর করেছিলেন দার্শনিক এস এম সুলতান৷
তাঁর আঁকা কৃষকের শরীর বাঙলার চিরায়ত প্রতিরোধ, ঘাম ও হাড়ের এক মহাকাব্যিক অভিব্যক্তি। যা দরশনের অর্থ হলো এক অন্যতর স্বপ্নে অবগাহন। সেই স্বপ্নে দারিদ্র্য আছে, কিন্তু হীনতা নেই। সেই স্বপ্নে মানুষ মাটির সন্তান, কিন্তু অসহায় নয়—বরং দেবতুল্য।
এটা ইউরোপীয় ক্ল্যাসিক্যাল রেনেসাঁর পেশিবহুল মানব শরীরের একটা দেশজ প্রতিসংস্করণ, যেখানে মাইকেলেঞ্জেলোর ডেভিড মিশে যাচ্ছে কুড়িগ্রামের করিমুল্লাহ চাচার শরীরের গাঁথুনিতে।
আরেকটি কথা, সুলতানের শিল্পধারা আধুনিকতার সঙ্গে একটা দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলে।
তিনি ওয়েস্টার্ন পার্সপেকটিভ ও ক্যানন এড়িয়ে নিজস্ব আঙ্গিকে গড়েছেন সেই ‘লোকজ রেনেসাঁ’।
তিনি মডার্নিজমের ঝলমলে cityscape আঁকেননি, আঁকেননি কোন machine বা techno-utopia।
তিনি বিশ্বাস করতেন প্রকৃত উন্নয়ন আসে কৃষিভিত্তিক সমাজে শিল্প-সাহিত্য-বুদ্ধিবৃত্তিকে পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে।
সুলতান তাই শিল্পীর চেয়ে বেশি—তিনি একজন বিপ্লবী চিন্তক, একজন counter-modernist।
সুলতানের চিত্রের মধ্যে এক ধরণের জ্যামিতি আছে, কিন্তু সেই জ্যামিতি ইউক্লিডীয় নয়—ওটা নদীর জ্যামিতি, ফসলের ঢেউয়ের জ্যামিতি।
তাঁর পটভূমি কখনও নিস্তরঙ্গ নয়—সবসময় তাতে একটা অস্থিরতা কাজ করে, যেন আকাশ ছিঁড়ে বৃষ্টি নামবে এখুনি।
তাঁর চিত্রকল্প সময়ের মধ্যে স্থির নয়—ওগুলো চলমান ইতিহাসের খণ্ডচিত্র।
বাঙলা চিত্রকলার ইতিহাসে এমন মহাকাব্যিক দৃশ্য কেউ আঁকেনি। ভবিষ্যতে আঁকবে কী না জানি না, তবে সন্দেহাতীতভাবে এমন শিল্পী আর আসবে না, সম্ভব না।
সুলতানী শতবর্ষ • ১০ আগস্ট ২০২৪