সমর সেন: স্বপ্ন ও পরাজয়ের কবি

❑ সাম্য রাইয়ান

“আমাদের স্বপ্ন হোক ফসলের সুষম বন্টন”—এই পংক্তিই সমর সেনের সমাজকল্পনা। যেখানে মানুষের শ্রমের মর্যাদা নিশ্চিত হবে, যেখানে ক্ষুধা-দারিদ্র্য নয়, ন্যায়সঙ্গত বণ্টন হবে জীবনের মূলনীতি। তাঁর কাব্যপথে এই স্বপ্ন যেমন উজ্জ্বল, তেমনি তা ভেঙে যাওয়ার করুণ আর্তিও সমান তীব্র। ত্রিশের দশকের বাঙলা কবিতায় তিনি সেই কণ্ঠস্বর, যিনি বিপ্লবের আহ্বানের পাশাপাশি ক্লান্তি, বিভ্রান্তি আর পরাজয়ের মুখোমুখি দাঁড় করালেন পাঠককে, যা নৈর্ব্যক্তিক অথচ গভীর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা।

তাঁর কবিতায় জীবনানন্দীয় রোমান্টিকতা নেই, নজরুলীয় উদ্দামতা নেই—আছে ক্ষয়ে যাওয়া সময়ের হতাশার খসখসে ছাপ। তিনি যে যুগে লিখতে শুরু করেছিলেন, সেই তিরিশের দশকে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ঢেউ, শ্রমিক-রাজনীতির উত্থান, আর একই সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অশনি সংকেত বাঙালি জীবনে প্রবলভাবে আঘাত করেছিল। কিন্তু সমর সেন এই ইতিহাসকে কবিতায় আনলেন একেবারেই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে—দেখালেন ক্লান্ত মানুষের অন্তর্গত বিপর্যয়।

তাঁর কবিতা বহন করে নিঃশব্দ আর্তি, শহরের অগণিত পরাজিত মানুষের স্বর। তিনি যে ব্যক্তিগত ক্লান্তি-হতাশা ও ভেঙে পড়ার কথা বলছেন, তা আসলে সমাজের বৃহত্তর ক্লান্তির প্রতীক।

রাজনীতির প্রতি স্পষ্ট সমর্থন নিয়েও তাঁর কবিতার ভাষা একেবারেই নৈর্ব্যক্তিক, প্রাত্যহিক ও বাস্তবানুগ। প্রচলিত ছন্দ-প্রকরণ ভেঙে, হঠাৎ থেমে যাওয়া বাক্যের ভেতরেই তিনি খুঁজে নিলেন সময়ের তিক্ততা।

সমর সেনকে মনে করা যেতে পারে সেই কবি, যিনি বাঙালি সাহিত্যে পরাজিত মানুষের কণ্ঠস্বরকে প্রথম সাহসের সঙ্গে কবিতায় রূপ দিয়েছিলেন। আর তাই তাঁর মৃত্যুদিন বা জন্মদিনে নয়, প্রতিদিনই যখন শহরের রাস্তায় ভগ্নস্বপ্নের ভিড় দেখি, তখনই তাঁর কবিতার শ্লথ অথচ ছুরির মতো ধারালো স্বর কানে বেজে ওঠে।

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *