নিঃসঙ্গতার একশ বছর

❑ সাম্য রাইয়ান

গত এক মাস ধরে ঘুরপাক খাচ্ছি নিঃসঙ্গতার একশ বছর–এ। মনে হল একটা নতুন ভাষা শিখছি, যার বর্ণমালাই কেবল নিঃসঙ্গতা, স্মৃতি আর ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বংশানুক্রম। বুয়েন্দিয়া পরিবার শুধু গল্পের চরিত্রমাত্র নয়, বরং একটি দার্শনিক কাঠামো—যার মধ্যে সময় মানে ঘূর্ণায়মান একটা গোলক, ইতিহাস এক অভিশাপ, আর ভাষা একটা ছায়াময় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন।

মার্কেস এখানে বাস্তবতার বিরুদ্ধে একটা মহাকাব্যিক প্রতিবাদ নির্মাণ করেছেন। ম্যাজিক রিয়ালিজম শব্দটা যতই ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে যাক, এই উপন্যাসে তার প্রকাশ এক নিপুণ রাজনৈতিক অভিব্যক্তি। ম্যাকোন্দো—এই কল্পিত শহর—একটা রাষ্ট্র নয়, বরং একটা অবচেতন রাষ্ট্র, একটা ঐতিহাসিক কল্পনা, যেখানে জনগণের স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা চলে ক্রমাগত, আর প্রতিটি প্রজন্ম তাদের পূর্বপুরুষের ভুলকেই আবার নতুনভাবে আবিষ্কার করে।

পৃথিবীর উপনিবেশিত অঞ্চলের জন্য মার্কেস এই উপন্যাসে এক বিশাল ব্যাখ্যা নির্মাণ করেন—একটা কৌতূহলী ও পরিহাস-ভরা ভবিতব্য, যেখানে ইতিহাস নিজেরই প্রতিরূপে আটকে পড়ে। ঔপনিবেশিক আধিপত্য, বাহ্যিক হস্তক্ষেপ, লাতিন আমেরিকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, পরিবারিক গ্লানি, নিষিদ্ধ প্রেম, এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মধ্য দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দেন ইতিহাস আসলে ‘লিনিয়ার’ নয়, বরং ‘সার্কুলার’, চক্রাকারে আবর্তিত।

উপন্যাসের সবচেয়ে বিহ্বলকর উপাদান সম্ভবত তার সময়চেতনা। আমরা দেখি—আজ যা ঘটে, তা আগেও ঘটেছে, আবার ঘটবে। সময় যেন একটা শেকলে বাঁধা কুয়োর দড়ি, যা ঘুরে ঘুরে আবার সেই একই অতলে গিয়ে পড়ে। এই গদ্যে ‘রিপিটিশন’ শুধু অলঙ্কার নয়—অনন্ত অভিশাপ।

রেমেদিয়োস দ্য বেলার মতো চরিত্ররা যেন ‘বাস্তবতার’ই এক অলীক প্রতিশ্রুতি। তিনি আক্ষরিক অর্থেই আকাশে উড়ে যান, কিন্তু সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হতে নয়, বরং নিজের ঐতিহাসিক চেতনার ভারমুক্ত হয়ে। তাকে নিয়ে মার্কেস যেন লিখে দেন, ভবিষ্যতের কোনো মুক্ত মানুষের ভবিষ্যদ্বাণী।

শেষের দিকে যখন অ্যুরেলিয়ানো বাবিলোনিয়া গোপন পাণ্ডুলিপি পাঠ করে বুঝে ফেলে—এই বংশধারা, এই স্মৃতি, এই ইতিহাস—সবই আগেভাগেই লেখা ছিল, তখন একটা রুদ্ধশ্বাস অনুভূতি তৈরি হয়। আমরা সবাই কি তবে পূর্বনির্ধারিত নিঃসঙ্গতার শিকার?

এই উপন্যাস তাই শুধু কল্পনার উচ্ছ্বাস নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক ‘counter-narrative’। মার্কেস এখানে ইউরোপকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চার এক অল্টারনেটিভ গদ্য নির্মাণ করেছেন—যেখানে জাদু আছে, কিন্তু সেটা নিছক অলৌকিক নয়; বরং মানুষের সংগ্রাম, প্রতিকূলতা আর প্রত্যাখ্যাত প্রেমের ভিতর থেকে উঠে আসা এক রাজনৈতিক চেতনার ভাষ্য।

আমরা যারা তৃতীয় বিশ্বের সন্তান, আমাদের সময় ও ইতিহাসও কি এইভাবেই ঘুরেফিরে আমাদের চারপাশেই প্যাঁচ খেয়ে থাকে? মার্কেসের ভাষায়, “অতীত আর ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই, আছে কেবল একটি চক্র, যেখানে কেউ মুক্ত নয়, কেউ নিঃসঙ্গতার বাইরে নয়।”

২০১৭ খ্রি.

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *