❑ সাম্য রাইয়ান
“জীবিত কাজী নজরুল ইসলামকে ‘কাফের-নাস্তিক-মুরতাদ’ খেতাব দিয়েছিল সমকালীন মোল্লা-মৌলভিরা; অর্ধমৃত নজরুলকে বাঙলাদেশ দিয়েছে নাগরিকত্ব, বানিয়েছে ‘জাতীয় কবি’। বাঙালি মুসলমান জীবিত প্রতিভাকে লাশে পরিণত করে, আর মৃত প্রতিভার কবরে আগরবাতি জ্বালে।”– হুমায়ুন আজাদ
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির এমন এক প্রতিভা, যিনি জীবিত অবস্থায় যতটা উপেক্ষা, তিরস্কার ও হেনস্তার শিকার হয়েছেন, মৃত্যুর পর ততটাই কৃত্রিম মহিমায় আবৃত হয়েছেন। তাঁর কবিতার বিপ্লবী সুর, গান ও প্রবন্ধের মুক্তচিন্তা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নির্ভীক উচ্চারণ তাঁর সমকালীন সমাজের কাছে ছিল ভয়ের।
আজ তাঁর কবিতার আগুনকে আমরা প্রদীপে রূপান্তরিত করেছি; তাঁর বিদ্রোহকে ভক্তির ফুলে ঢেকে দিচ্ছি। অথচ সত্যিকারের নজরুলকে গ্রহণ করতে যে সাহস প্রয়োজন, তা এ সমাজের নেই—কারণ তিনি ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে শঙ্খধ্বনি, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বজ্রনিনাদ।
বাঙলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পর তাঁকে “জাতীয় কবি” ঘোষণা করা হয়, কিন্তু তখন তিনি ছিলেন স্মৃতিভ্রংশ, কার্যত অচেতন। তাঁর জীবন্ত কণ্ঠ, তাঁর বিদ্রোহী ভাষা তখন আর শোনা যায়নি। রাষ্ট্র তাঁকে যে সম্মান দিয়েছে, তা একরকম প্রতীকী শোকাচ্ছাদন মাত্র। ভাবুন তো—যদি তিনি জীবিত থাকতেন তাঁর পূর্ণ শক্তিতে, তবে কি আমরা তাঁকে সহ্য করতে পারতাম? নাকি আবার তাঁকে দমন করার জন্যই ষড়যন্ত্র হতো, মবের আক্রমণ হতো?
আজকের বাঙলাদেশে নজরুলের কবিতা প্রায়ই আনুষ্ঠানিকতার আসরে উচ্চারিত হয়, অথচ তাঁর মূল বিদ্রোহী চেতনা, সাম্যের ডাক, ধর্মীয় ভণ্ডামির বিরুদ্ধে অবস্থান—সবই চাপা পড়ে গেছে। নজরুলকে মৃত প্রতীকে পরিণত করা হয়েছে, তাঁর জীবন্ত ভাবনা ও বিপ্লবী দিকটিকে অস্বীকার করা হয়েছে।
বাঙলাদেশ নজরুলকে জাতীয় কবি করেছে, কিন্তু তাঁর চিন্তাকে জাতীয় চেতনায় রূপান্তর করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর বিদ্রোহকে আমরা পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ করেছি, কিন্তু জীবনে প্রয়োগ করিনি। নজরুল আজ তাই এক অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি—যাকে আমরা স্মরণ করি, কিন্তু পালন করি না।