শিল্পের স্বাধীনতা বনাম কালচারাল ফ্যাসিবাদ

❑ সাম্য রাইয়ান

কালচারাল ফ্যাসিস্ট প্রসঙ্গটি কেবল আমাদের স্থানীয় অভিজ্ঞতার বিষয় নয়, বরং এটি এক আন্তর্জাতিক বাস্তবতা। ইতিহাসে দেখা গেছে, যখনই কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা টিকে থাকার জন্য বৈধতা হারায়, তখন তারা সংস্কৃতির দিকে হাত বাড়ায়। মুসোলিনি থেকে হিটলার পর্যন্ত—সবারই এক অভিন্ন নীতি ছিলো: শিল্প হবে রাষ্ট্রের সেবক, সাহিত্য হবে শাসকের প্রশংসাগান। জার্মানিতে নাৎসি শাসন কবি ও শিল্পীদের ‘ডিজেনারেট’ বলে চিহ্নিত করেছিল, তাদের বই আগুনে পোড়ানো হয়েছিল। 

এই অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট যে, কালচারাল ফ্যাসিস্টের মূল হাতিয়ার হলো বৈচিত্র্যের ধ্বংস। তারা শিল্পকে যেভাবে কেটে-ছেঁটে ফেলে, তাতে মানুষের সৃষ্টিশীলতার প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু শিল্প-সাহিত্য এক ধরণের অরণ্যের মতো—যেখানে একই সঙ্গে অশ্বত্থ, বট, নিম আর কাশফুল বেড়ে ওঠে। কালচারাল ফ্যাসিস্ট চায় না এই বৈচিত্র্য, তারা চায় সমতল মাঠ, যেখানে কেবল তাদের রোপণ করা গাছ থাকবে।

আজকের পৃথিবীতেও এই প্রবণতা থেমে নেই। পাশ্চাত্যে ‘কালচারাল ওয়ার’ নামে নতুন এক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। বই নিষিদ্ধকরণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য পরিবর্তন, ‘অপছন্দের শিল্প’ বাতিল করা—এসবের ভেতরেও কালচারাল ফ্যাসিবাদের রেশ পাওয়া যায়। আমাদের দেশেও দেখা যায়—কোনো নাটক মঞ্চস্থ হতে না দেওয়া, কোনো গানকে ‘অপসংস্কৃতি’ ঘোষণা করা, কিংবা কোনো লেখককে চুপ করিয়ে দেওয়া। এগুলো সব একই ধারার অংশ।

তবে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো ষড়যন্ত্রমূলক উল্টোপথে নাম দেওয়া। অনেক সময় প্রকৃত কালচারাল ফ্যাসিস্টরাই তাদের সমালোচকদের ‘কালচারাল ফ্যাসিস্ট’ বলে চিহ্নিত করে। ফলে যে ব্যক্তি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য লড়ছে, তাকেই অভিযুক্ত করা হয় দমননীতির দায়ে। এই বিভ্রান্তি পরিকল্পিত, যাতে মানুষ আর প্রকৃত শত্রুকে চিনতে না পারে। ঠিক যেমন রাজনীতিতে ভুয়া অভিযোগ ব্যবহার করে ভিন্নমত দমন করা হয়, সংস্কৃতিতেও একই কৌশল ব্যবহৃত হয়।

তাই আমাদের দায়িত্ব হলো দ্বিগুণ সতর্ক হওয়া। একদিকে আমাদের প্রতিরোধ গড়তে হবে সেই শক্তির বিরুদ্ধে, যারা সংস্কৃতিকে বন্দি করতে চায়। অন্যদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, যেন ভুল মানুষকে কালচারাল ফ্যাসিস্ট আখ্যা দেওয়া না হয়। ভুল আঙুল তোলা মানে আসল বিপদের পথ খুলে দেওয়া।

শেষ পর্যন্ত সংস্কৃতি আমাদের মুক্তির জায়গা, যেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে গান গায়, কবিতা লেখে, নাটক মঞ্চস্থ করে, গল্প শোনায়। কালচারাল ফ্যাসিস্ট চায় সেই স্বাধীনতার মৃত্যু। তাই তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানে কেবল শিল্পের পক্ষে দাঁড়ানো নয়, বরং মানবমুক্তির পক্ষে দাঁড়ানো।

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *