❑ সাম্য রাইয়ান
আমি প্রথম ব্রেখট পড়ি কলেজে পড়ার সময়। তখন নাটক নিয়ে তেমন বোঝাপড়া ছিল না—ছিল কেবল গল্পের টান, চরিত্রের ভেতর ঢুকে পড়ার আনন্দ। কিন্তু মাদার কারেজ পড়ে আমি জাস্ট স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কেননা ব্রেখটের নাটক চরিত্রকে কেবল “বিশ্বাসযোগ্য” করে না, বরং চরিত্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমার কাছে এ এক অদ্ভুত উলোটপালোট অভিজ্ঞতা ছিল; গল্পে নিমগ্ন হওয়ার বদলে আমি গল্পের কাঠামো নিয়েই ভাবতে শুরু করলাম। অস্কার ইউস্টিস মাদার কারেজকে বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক এবং সম্ভবত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ যুদ্ধবিরোধী নাটক বলে মন্তব্য করেছিলেন।
ব্রেখটের সবচেয়ে বড় সাহস ছিল নাটককে বিনোদনের নিরাপদ অঞ্চল থেকে সরিয়ে এনে চিন্তার ক্ষেত্র বানানো। তাঁর “Verfremdungseffekt”—যাকে আমরা বিচ্ছিন্নকরণ প্রভাব বলি—ছিল এই তত্ত্বের কেন্দ্রে। ব্রেখট বিশ্বাস করতেন, নাটক দর্শককে গল্পে ডুবিয়ে রেখে নিষ্ক্রিয় করে তুলবে না; বরং দূরত্ব তৈরি করবে, যাতে দর্শক সমালোচনামূলক বোধ নিয়ে ঘটনাগুলো ভাবতে পারে। হয়তো এজন্যই তাঁর নাটক পড়তে গিয়ে আমি বারবার কেবল চরিত্রের সাথে নয়, লেখকের সাথেও আলাপ করতে চাইতাম—কেন এখানে এই সংলাপ, কেন ওই মঞ্চ-নির্দেশনা?
ব্রেখট শিল্পীকে সমাজের এমন অংশ হিসেবে দেখতেন, যে সমাজের অবিচারকে দেখে, বুঝে, এবং প্রকাশ করতে দ্বিধা করে না। তাঁর গ্যালিলিও’র জীবন নাটকে বৈজ্ঞানিক সত্য আর রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এমনভাবে এসেছে, যা পড়লে আজকের পৃথিবীর জ্ঞানবিরোধী রাজনীতির মুখোশও খুলে যায়। গ্যালিলিও এখানে নায়কও, আবার আপসকামী মানুষও—এ দ্বৈততা আমাদের দেখায়, ইতিহাস শুধু গৌরবের নয়, লজ্জারও দলিল।
ব্রেখটকে স্মরণ করার মানে সেই দৃষ্টিকে স্মরণ করা—যা আমাদের স্বস্তি ভাঙতে বাধ্য করে। আজকের বাঙলাদেশি থিয়েটার বা সাহিত্যেও যদি আমরা একটু ব্রেখটীয় দূরত্ব আনি, তবে হয়তো দর্শক হাসিকান্নার অনুভূতির পাশাপাশি প্রশ্নও করতে শিখবে। কেন এই চরিত্র এমন হলো? কেন এই সমাজ এমন? কেন আমি এমন?
লেখক হিসেবে আমার জন্য ব্রেখটের বড় শিক্ষা—গল্প বলো, কিন্তু গল্পের ভেতরে থাকা গোপন যন্ত্রগুলোও দর্শককে দেখাও। কারণ সচেতন দর্শকই একমাত্র পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। হয়তো এজন্যই তিনি বলেছিলেন— “শিল্প কেবল আয়না নয়, হাতুড়িও বটে—যা দিয়ে আমরা পৃথিবীকে গড়তে পারি।”