❑ সাম্য রাইয়ান
বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যুসংবাদ আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। তাঁর শেষ খোলা চিঠি আমি বারবার পড়েছি—এক জীবনের হিসাবনিকাশ, এক সাংবাদিকের ব্যক্তিগত অথচ রাজনৈতিক আত্মজিজ্ঞাসা। পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা করা মানুষটির মৃত্যুর আগে এমন অসহায় স্বীকারোক্তি রেখে যাওয়া কেবল ব্যক্তিগত বেদনা নয়, বরং বাঙলাদেশের বর্তমান সাংবাদিকতার অবস্থার নির্মম দলিল।
বিভুরঞ্জনের লেখায় দেখা যায়, তিনি সত্য প্রকাশ করেছেন কিন্তু তার বিনিময়ে পেয়েছেন আর্থিক অনটন, পেশাগত বঞ্চনা, সামাজিক অস্বস্তি। অথচ তার চারপাশে একই সময়ে এমন মানুষ ভেসে উঠেছে যারা সাংবাদিকতাকে বাণিজ্যিক পণ্য বানিয়ে সুবিধা ও পুরস্কার অর্জন করেছে। তাঁর “আমি নাম আড়াল করলেও সত্য গোপন করিনি”—এই বাক্য আজকের সাংবাদিকতার প্রেক্ষাপটে ভয়ংকর প্রাসঙ্গিক। কারণ এখন নাম-পরিচয় প্রকাশ করে অনেকেই গোপন করে ফেলছেন মূল সত্য, আর সত্যের ঝুঁকি নিচ্ছেন কেবল প্রান্তিক কয়েকজন।
বাঙলাদেশের সাংবাদিকতা বর্তমানে এক দ্বিধাবিভক্ত বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে। একদিকে, ক্ষমতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা যারা তৈরি করেছে তারা প্লট, বিদেশ সফর, মোটা সম্মানি, আর আর্থিক নিরাপত্তা অর্জন করছে। অন্যদিকে, যারা ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সত্য প্রকাশ করছে, তারা কর্মস্থলে অবহেলিত, সমাজে নিঃসঙ্গ, আর ব্যক্তিগত জীবনে দারিদ্র্যপীড়িত। বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু তাই শুধু একজন প্রবীণ সাংবাদিকের ট্র্যাজেডি নয়, বরং পুরো গণমাধ্যমের অবক্ষয়ের প্রতীক।
বাঙলাদেশে সাংবাদিকতা আজ আর মূলত পেশা নয়, বরং ক্ষমতা ও সুবিধার দালালি আর চুপ থাকার চুক্তিতে পরিণত হয়েছে। যখন কেউ সাহস করে এর বাইরে দাঁড়ায়, তখন তাকে অচল করে দেওয়া হয়, তার লেখা “পাঠক খায় না” বলে বাতিল করা হয়।
বাঙলাদেশি সাংবাদিকতার বর্তমান সংকটকে বুঝতে হলে এর অর্থনৈতিক কাঠামোর দিকে তাকাতে হয়। দেশের প্রায় সব পত্রিকাই আজ বিজ্ঞাপননির্ভর—তাও মূলত কর্পোরেট বিজ্ঞাপন ও সরকারি বিজ্ঞাপন। কর্পোরেট বিজ্ঞাপনের কারণে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বেতন বকেয়া রাখতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞাপনদাতাদের কোনো সমালোচনা ছাপানো যায় না। সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীলতার ফলে সংবাদপত্রগুলো সরকারবিরোধী সত্য প্রকাশ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। আর অনলাইন পোর্টালের যুগে অধিকাংশ সাংবাদিক মাসের পর মাস বেতন পান না, পানও যদি সেটা হয় ১০-১৫ হাজার টাকার অল্প পরিমাণ। সাংবাদিক ইউনিয়নগুলিও কার্যকরভাবে এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারছে না।
এই অর্থনৈতিক কাঠামোর ফাঁদে সাংবাদিকরা নিজেরাই ভেঙে পড়ছেন। তারা বাধ্য হচ্ছেন পার্টটাইম চাকরি করতে, মালিকের পক্ষের প্রচারণা চালাতে বা নিজের বিবেককে বারবার অস্বীকার করতে। এর ফলে সাংবাদিকতা হয়ে যাচ্ছে কেবল টিকে থাকার জন্য এক প্রকার বাজারি পণ্য, যেখানে মূলধারার বাইরে যারা সত্য বলছেন তারা বেকার হয়ে পড়ছেন, দারিদ্র্যপীড়িত হচ্ছেন।
বিভুরঞ্জন সরকার শেষ চিঠিতে লিখেছিলেন, “আমার জীবনে কোনো সাফল্যের গল্প নেই। সাংবাদিক হিসেবেও এডাল ওডাল করে কোনো শক্ত ডাল ধরতে পারিনি।” এই আত্মস্বীকারোক্তি ভয়ংকর সত্যকে উন্মোচন করে—বাঙলাদেশের সাংবাদিকতায় আজ আর “সাহসী সত্যবক্তা”দের জায়গা নেই। তারা শেষ পর্যন্ত হারিয়ে যান একা, ঋণগ্রস্ত, উপেক্ষিত।
তবু তাঁর মৃত্যুর পরও আমার মনে হয়, বিভুরঞ্জন সরকারের চিঠিই সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে—সত্য প্রকাশ করা এখনও সম্ভব। যদিও তার মূল্য ভয়ংকর। বাঙলাদেশের সাংবাদিকতা যদি আবার ন্যায্যতা ও জনস্বার্থের দিকে ফিরে যেতে চায়, তবে বিভুরঞ্জন সরকারের জীবনের এই করুণ অথচ আলোকিত দলিল থেকে শিক্ষা নিতেই হবে। নাহলে আমাদের সাংবাদিকতার পরিণতি হবে আরও অন্ধকার, যেখানে থাকবে কেবল প্রচারণা আর বাজারি সংবাদ, কিন্তু অনুপস্থিত থাকবে মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো সাহসী কণ্ঠস্বর।
দিনহীনের দিনলিপি : ২২ আগস্ট ২০২৫