❑ সাম্য রাইয়ান
সাহিত্যের ইতিহাসে কিছু নাম থাকে যাদের আলো একেবারে সরাসরি দেখা যায় না, বরং আড়াল ভেদ করে আসে—নরম অথচ অনমনীয়, ধুলোমাখা অথচ অমোঘ। অরুণেশ ঘোষ এমনই এক কবি, কথাসাহিত্যিক; একজন গৃহস্থ মানুষ, যিনি শিক্ষকতা করেছেন, জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন গ্রামের মাটিতে, অথচ তাঁর ভেতরে যে কবি জন্মেছিল, তার অগ্রসর মানসিকতা, মানবিক বোধ ও আত্মঘাতী নির্জনতা বাঙলা কবিতার মাটিকে গভীরভাবে চিহ্নিত করে গেছে। তাঁর জীবনযাপন ও সাহিত্যকে আলাদা করা যায় না; তাঁর কবিতা আসলে তাঁর প্রতিদিনের প্রান্তিক বাস্তবতার বয়ান। অরুণেশ ঘোষকে বুঝতে চাইলে বাঙলা কবিতার শহরকেন্দ্রিক মানসিকতা থেকে সরে এসে গ্রাম, অভাব, শ্বাসরুদ্ধ জীবন, এবং নিঃশব্দ মৃত্যুর দিকে তাকাতে হয়।
জন্ম ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরের শেষপ্রহরে, কুচবিহারের এক অখ্যাত গ্রাম হাওয়ারগাড়িতে। এই গ্রামেই তিনি জীবন কাটিয়েছেন, সেখানেই লিখেছেন। সেসময়ে বাঙলা সাহিত্যের প্রায় সবাই শহর, প্রকাশক, সেলিব্রিটি সংস্কৃতি বা রাজনীতির টানে একদিন না একদিন কলকাতা মুখী হয়েছেন—কিন্তু অরুণেশ ঘোষ এ নিয়ম ভেঙেছিলেন। গ্রাম ছাড়েননি। গ্রামই ছিল তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়, তাঁর মঞ্চ, তাঁর কবিতার ভিত।
ষাটের দশকের শুরুতে হাংরি সাহিত্যিকরা যখন কবিতা-ভাষায় ভূমিকম্প সৃষ্টিতে মত্ত, তখন অরুণেশ অল্পবয়সী এক পাঠক। সেই তিনিই পরে ‘জিরাফ’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করে হাংরি আন্দোলন পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করেন। বলা হয়, তাঁর হাংরি সম্পর্কটা ছিল প্রতীকি ও স্বতন্ত্র। তিনি কেবল শহুরে অভিজাত কবিতার বিরুদ্ধে ছিলেন না, তিনি গ্রাম্য কবিতার এক বাস্তবতাকে গড়ে তুলেছিলেন, যেখানে মানুষের বেঁচে থাকার রূঢ় অথচ গভীর ছবি অঙ্কিত।
তাঁর মৃত্যু হয় ২০১১ সালের আগস্টে, এক পুকুরে ডুবে। দুর্ঘটনা না আত্মহত্যা—এ নিয়ে আজও প্রশ্ন আছে। কিন্তু যেভাবেই হোক, এই মৃত্যু অরুণেশ ঘোষকে আরও রহস্যময় করে তোলে। অনেকেই বলেন, তাঁর জীবনযাত্রা সমাজ-প্রান্তিক মানুষের সাথে এতটাই মিশে গিয়েছিল যে নিজেকেও তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন।
অরুণেশ ঘোষ হয়তো বিখ্যাত নন, কিন্তু অত্যাবশ্যক। কেননা তিনি বাঙলা কবিতার এক ভিন্নতর স্রোত—যেখানে মাটি, দুঃখ, এবং অন্ধকার একত্রে প্রবাহিত।
দিনহীনের দিনলিপি : ২৪ আগস্ট ২০২৫