❑ সাম্য রাইয়ান
“Let us go then, you and I,”
—এই আহ্বানের মধ্যে কি প্রেমের গোপন গন্ধ লুকানো আছে? নাকি শুধু একাকীত্বের কাতর স্বীকারোক্তি? টি এস এলিয়টের The Love Song of J. Alfred Prufrock কোনো প্রেমের গান নয়, বরং এক ভেঙে-পড়া মানুষের আত্মসমীক্ষা—যেখানে প্রেম আসেনি বলেই তার প্রেম-হীনতা নিয়ে এত কথা। কবিতার নায়ক প্রুফ্রক এক অনিশ্চিত, দ্বিধাগ্রস্ত, অসহায় আধুনিক মানুষ—যে আত্মপ্রেমিক, কিন্তু আত্মবিশ্বাসী নয়। কবিতার আড়ালে সেই প্রশ্নবিদ্ধ মানুষের মুখই উঁকি দেয়, যার গলায় আটকে থাকে ‘Do I dare?’—এর মতো বাক্য।
টি এস এলিয়ট কবি হিসেবে এমন এক উচ্চতায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, যেখানে তাঁর প্রতিটি শব্দে মিশে ছিল ইতিহাস, পুরাণ, ধর্ম, দর্শন ও ব্যক্তিগত অনুভবের সংমিশ্রণ। আলোচ্য কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১৫ সালে Poetry: A Magazine of Verse-এ, যখন বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপ কেবল রাজনৈতিক বা সামরিক পরিসরে নয়, মানুষের মনোজগতে ভয়াবহ ছাপ রেখে চলেছে। সেই প্রেক্ষাপটে প্রুফ্রক হয়ে ওঠেন এক মানসিক উদ্বেগের প্রতীক।
প্রুফ্রকের ভাষা, তার বাক্যবন্ধ, তার চিন্তার গতিপ্রকৃতি—সবই যেন এক আত্মপর্যবেক্ষণের ধারাবাহিকতা। ‘I have measured out my life with coffee spoons’—এই বাক্যে বুঝিয়ে দেয় সময় কেমন একঘেয়ে, কেমন নিরানন্দ ও ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছে। একটি গোটা জীবনের হিসাব কফির চামচ দিয়ে মাপা—এ যেন বিষণ্নতা ও আত্মসমালোচনার এক চরম রূপক। এখানে সময় কোনো মহাকাব্যিক মহিমা নয়, বরং দৈনন্দিনের ক্লান্তিকর টানাপোড়েন।
কবিতাটি শুরু হয় দান্তের Inferno থেকে নেওয়া এক উদ্ধৃতি দিয়ে—যা প্রমাণ করে এলিয়ট কেবল আধুনিক নন, তিনি সাহিত্য-ঐতিহ্যের উত্তরসূরিও। তিনি পুরাণ ও ইতিহাসকে আধুনিক চেতনাজগতে টেনে এনেছেন, যেন দেখাতে চান—মানুষ বদলায়, সময় বদলায়, কিন্তু আতঙ্ক, সংশয়, পাপবোধ ও আত্মগ্লানির মতো অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো চিরকালীন। এলিয়টের এই কাব্যভাষা কঠিন, সংকেতময়, কিন্তু একবার এই সংকেতগুলোর মানে খুঁজে নিতে পারলে, পাঠকের সামনে এক অন্য জগত খুলে যায়।
এখানে প্রেম নেই, অথচ কবিতার নাম ‘Love Song’। কিন্তু তাই বলে এলিয়ট আমাদের ফাঁকি দেন না, বরং প্রশ্ন করেন—‘What is love in a world so barren, so self-conscious, so filled with doubt?’ এই কবিতা প্রেমের এক অনুপস্থিতি থেকে জন্ম নেয়। প্রুফ্রকের প্রেমের গান মানেই তার প্রেমহীন জীবনের রুদ্ধ কান্না। হয়তো তাই কবিতার শেষে এসে সে বলে:
“I do not think that they will sing to me.”
এই ‘they’ কে? প্রেমিকারা? সমাজ? ইতিহাস? পাঠক?—এলিয়ট উত্তর দেন না। এবং এখানেই কবিতাটি হয়ে ওঠে বহুমুখী পাঠের জন্য প্রস্তুত এক রূপান্তরযোগ্য শিল্পকলা।
এলিয়ট বিশ্বাস করতেন, একজন কবিকে কেবল অনুভূতির ধারক হলেই চলবে না; তাকে হতে হবে দার্শনিক, ঐতিহাসিক ও আত্মসচেতনও। এলিয়ট নিজে ছিলেন গোঁড়া ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী, অথচ আধুনিকতার সমস্ত জটিলতা ও সংশয় নিয়ে লিখেছেন। ফলে তাঁর কবিতায় ধর্ম এক নৈতিক বিবেচনা বা চেতনার বিষয়, কেবল বিশ্বাসের রূপ নয়। প্রুফ্রকের মধ্যে সেই ধর্মবোধ নেই, কিন্তু আছে গ্লানিবোধ। এটা একরকম পাপবোধ, যেখানে অপরাধ নেই, কিন্তু আত্মসমালোচনা আছে।
এই কবিতায় শহরের অলিগলি, বিকেলের কুয়াশা, ধুলোজমা জানালা, মুচমুচে রুটি ও চায়ের কাপ—সবই যেন এক উদাসীন, জড় অথচ প্রাণবান বাস্তবতার অভিজ্ঞতা। শহর এখানে মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়, তাকে আত্মগত করে তোলে। এলিয়ট এক শহুরে আধুনিকতার কবি—যেখানে শহর মানে আত্মপরিচয়ের সংকট।
প্রুফ্রক কথা বলে, কিন্তু সেই কথা পৌঁছে না। কবিতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ লাইন হলো—
“That is not it at all,That is not what I meant, at all.”
এই বাক্য দুটো যেন আমাদের সকল ‘miscommunication’-এর সারমর্ম। এলিয়ট আমাদের বলে দেন না কী করতে হবে, বরং আমাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রশ্নগুলোকে চিহ্নিত করেন। তাই তাঁর কবিতা বোঝা কঠিন—কারণ সেটি সরল বার্তা দেয় না, বরং জটিল অভিজ্ঞতার দিকে আমাদের ঠেলে দেয়।
একসময় প্রুফ্রক স্বপ্ন দেখে, সে হয়তো “a pair of ragged claws / Scuttling across the floors of silent seas” হয়ে যেতে পারত। এ যেন এক হিরো হতে না পারার শোকগাথা। এই অনুপুঙ্খ বর্ণনায় মানুষটির আত্মতাড়না ফুটে ওঠে। সে জানে, তার কথায় কেউ সাড়া দেবে না; তাই সে নিজের সঙ্গে কথা বলে।
টি এস এলিয়ট বলেছিলেন,
“Genuine poetry can communicate before it is understood.”
The Love Song of J. Alfred Prufrock কবিতাটি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। পাঠক প্রথমে হয়তো কিছুই বোঝেন না, কিন্তু অনুভব করেন। এই অনুভবের মধ্যেই কবিতার বাস্তবতা; কেননা এলিয়টের কবিতা ‘বোঝা’ নয়, ‘অনুভব’ দাবি করে।