‘তারারা’ সাহিত্যের আলোকপত্র তার পূর্ব প্রতিশ্রুতিমতো ত্রৈমাসিক আত্মপ্রকাশ প্রধারা বজায় রেখেও অতিরিক্ত বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের ভাবনা ভেবেছিল। কোনও এক সময় প্রতিটি নিয়মিত সংখ্যার সঙ্গে সময়ের দাবি মেনে ক্রোড়পত্রও জুড়ে দেবার বাসনা রেখেছিল। ‘তারারা’ স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে, তবে কোনও এক নির্দিষ্ট স্বপ্নের আঠাদণ্ডে ডানা লেপ্টে যাওয়া রামধনু দেশের নিরীহ প্রজাপতির প্রাণান্তক আই-ঢাই স্বপ্নকে ভয় পায়। শিউরে ওঠে। তারাদেশের বিমুক্ত অফুরান আকাশের সর্বোচ্চ প্রক্ষেত্র থেকে মুহুর্মুহু আলো ছুটে আসছে, এপারের আলোভূক, চেতনাভূক তারা-চেতন প্রমিথিউস সাধ্যমতো সেই আলোয় স্নান সেরে ফকিরের ঝোলা নিঃসৃত কিছু আলো-শব্দ আলো-বাক্য পাঠকের হৃদি রেখাতটে রেখে যাচ্ছে। ‘তারারা’-র দ্বেষ নেই, দেশ নেই, কোন নির্দিষ্ট ভূখণ্ড নেই, অথচ তারাভূক কিছু সাধক স্ব-স্ব ভূখণ্ডে দু’পা রেখে অনন্ত প্রজ্ঞাভূখণ্ডের মালিকানা হাতে তুলে নিয়েছে। এই জগত সৃজনের জগত। মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়েও এই জগতের কারবারিদের তাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করা যায় না, যায় নি। ‘তারারা’ পত্রিকা পরিবার ‘আলো হয়, গেল ভয়, চারিদিক ঝিকমিক’ তারা-প্রাণদের অকুণ্ঠ কুর্নিশ জানায়।
‘তারারা’র এই বিশেষ সংখ্যা যাকে নিয়ে সজ্জিত, তিনি সেই কবি— তিনি সেই সম্পাদক— যিনি সেই মুক্তগদ্য লেখক যাকে কখনও চোখে দেখিনি। শুধু তাঁর কবিতা পড়ে পূর্বরাগে আক্রান্ত হয়েছিলাম, শরতের এক সন্ধেবেলা। সেই কবির নাম সাম্য রাইয়ান। সাম্য রাইয়ান মূলত কবি, একজন জাত-কবি বলতে যা বোঝায় সেই তরুণ কবিকে নিয়ে ‘তারারা’র এই বিশেষ সংখ্যা এবং তারারা পরিবারের প্রথম বিশেষ সংখ্যার শুরুয়াত এই কবিকে দিয়েই। আগেই বলেছি কবিদের কোন দেশ নেই, নির্দিষ্ট কোন ভূখণ্ড নেই। আমরা ক্ষুদ-বিতর্কে মাস-মাহিনা কাবার করা হাড়-হারামি কাঁকড়া প্রজাতি বদ্ধ পাঁকে এ ওর পা কামড়ে পড়ে থাকি। দেখেও দেখি না, বুঝি না বলে বোঝার চেষ্টাও করি না। নয়ের দশকে জন্মগ্রহণ করা এই কবিকে নিয়ে প্রথিতযশা প্রাবন্ধিক, কবি-সাহিত্যিকেরা বাঁকফেরা নতুন স্বপ্নঘোর তপ্তপ্রাণ কবিকে নিয়ে লিখেছেন। তাঁকে অনুধ্যান করেছেন। স্মৃতির পুনরূদ্ধার করেছেন, কবির রচনার বহুমুখী আলোকসম্ভাব্য এবং সার্থকতম সময়োত্তীর্ণ ভাব অনুভবগুলিকে মেধার সোনামুখী সুঁইয়ে পাঠকসমীপে গেঁথেছেন, বুনেছেন। একজন তরুণ কবিকে এখনই সুঁইগ্রন্থিতে গাঁথার কী প্রয়োজন ছিল? পক্ষে-বিপক্ষে দুই সারিতেই হাজারও মতামত থাকবে। তবুও সম্পাদক হিসেবে চরম শ্লাঘা এবং আত্মতুষ্টি এইখানেই যে, অনেক যুক্তি, প্রতি-যুক্তি, তর্ক, প্রতি-তর্ক, মতামত, প্রতি-মতামত উপরোধ, অনুরোধ করে শেষপর্যন্ত তরুণ কবির কাছ থেকে তাঁর নামে সংখ্যা প্রকাশের ছাড়পত্র পাওয়া গেছে। একজন কনিষ্ঠ সম্পাদক হিসেবে কবির কাছ থেকে এইরকম ছাড়পত্র আদায়— একটা জিৎ বলেই ধরে নিচ্ছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন— “এমন গরিবও আছে, যাহারা প্রাণ খুলিয়া কাহারো প্রশংসা করিতে পারে না।” এই সত্যই যেন বারবার বর্তমান সংখ্যা প্রকাশের সময়ে আমাদের সামনে নির্মমভাবে উপস্থিত হয়েছে। এমন অনেকেই মেসেঞ্জারে, হোয়াটসঅ্যাপে উপস্থিত হয়ে নিজের দরিদ্রতাকেই প্রস্ফূটিত করে তুলেছেন। বারবার মনে পড়েছে কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর কথা, “কোন কবিকে অস্বীকার করতে দু’চার মিনিট লাগে— স্বীকার করতে লাগে কয়েক বছর।” আমরা ‘তারারা’ পরিবার নতুন কবিতার স্বর পাঠকের সামনে তুলে ধরতে, তাকে বিশ্লেষণ করতে এবং সাহিত্যতত্ত্বের নিরীখে সেই স্বর পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ তথা ব্যবচ্ছেদ করতে চেয়েছি। সাম্য রাইয়ানের মতো কবি-স্বরকে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছি। এর পরে যদি কারোও কিছু বলার থাকে, তিনি বলবেন— তিনি মহাকাল। তরুণ কবি সাম্য রাইয়ানকে তাই ‘তারারা’ পত্রিকা এবং পত্রিকা পরিবারের পক্ষ থেকে আভূমি আনত শ্রদ্ধা। ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা আর ঐকান্তিক প্রার্থনা তাঁর কলম চলুক, আরও চলুক কাব্যভুবনের অদৃশ্য বন্ধনহীন এক একটি গ্রন্থির জঠর ছিঁড়ে বেরিয়ে আসুক নতুন নতুন সৃজন-সকাল।
সবাই ভালো থাকুন। পত্রিকার এই সংখ্যার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী, হিতাকাঙ্ক্ষী সকলকে অনিঃশেষ ধন্যবাদ, প্রীতি, প্রণাম। একজন সমকালীন কবিকে প্রসঙ্গ করে প্রাজ্ঞ প্রাবন্ধিকগণ রাতদিন এককরে ঘাম ঝরিয়ে আলোচনাগুচ্ছ লিখেছেন, তা আমাদের তথা আগামী সময়ের সম্পদ হয়ে রইল। আপনাদের বিপুল অংশগ্রহণ, জোর সমর্থন, অনুপ্রেরণা ব্যতিরেকে এত বৃহৎ কলেবর নিয়ে পত্রিকা প্রকাশ ছিল অসম্ভব। পত্রিকা সৃজন প্রকৌশলের পেছনে থাকা সেইসব অক্ষর-মুদ্রণজীবী মানুষদের, যারা ব্যক্তিনাম নয়, গোষ্ঠীনামে- ব্র্যান্ডনেমে, সুচারু কাজ আর ‘তারারা’র অধরা স্বপ্নকে অসম মেহনত দিয়ে এই সংখ্যার রূপকর্তা হয়ে রইলেন, তাদের সকলকে আন্তরিক প্রীতিময় শুভেচ্ছা। ‘তারারা’র এই বিশেষ সংখ্যা পত্রিকার দৃষ্টিনন্দিত প্রচ্ছদকর্তার নাম না নিলে খুব অন্যায় হবে। একাধারে কবি, গল্পকার, উপন্যাসিক এবং প্রচ্ছদশিল্পী এই বহুধা গুণের অধিকারী দয়াময় বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিশেষিত করা যায় এমন বিশেষণ আমার জানা নেই এবং কোনও বিশেষণই তাঁর গুণপণাকে সঠিকভাবে মাপা যায় না— কাজেই সেই চেষ্টা থেকে বিরত থাকলাম। ‘তারারা’র অগণিত পাঠক সাধারণ, সমালোচক-জনার্দনকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা— আবার দেখা হবে— তুমুল কথা হবে, এই বাসনায় পাঁজর ফুলিয়ে অনেকটা সুবাতাস একসঙ্গে ফুসফুসে টেনে নিলাম।
আশুতোষ বিশ্বাস
স্বাগতা বিশ্বাস
[তারারা • জুন ২০২৩ • সাম্য রাইয়ান সংখ্যা]