(১)
বাংলার উত্তর জেলার বাসিন্দা কবি সুবীর সরকার। পরিচয়ের পর আমি তাঁকে উত্তরের হাওয়া বলি। হওয়ার যেমন কোনো প্রবাহের দিক নেই,নেই অভিমুখ, কখনও শান্ত আবার কখনও প্রশান্ত হয়ে গাছের পাতায় শীতলতা প্রদান করে, সুবীরদাও তেমনই এক মুক্তমনা মানুষ। মাথার মধ্যে যার সবসময় ঘোরাফেরা করে শব্দের দোতারা। আজকের একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এমনটা যে ঘটে তা এই বই তৈরিতেই অনেকটা বুঝতে পেরেছি। এখন প্রশ্ন কী ঘটছে বা ঘটতে যাচ্ছে। এপার বাংলা আর ওপার বাংলা। মাঝখানে আছে সীমন্ত কাটাতার। এপক্ষ ওপক্ষ। বিবাদ। বদনাম। কাঁটা তারের বেড়া পেরিয়ে রাতের অন্ধকারে কত কত জীবিকার টানে এক দেশের মাটি থেকে অন্যদেশের মাটিতে চলে যাওয়া। এই যাওয়ায় আনন্দ থেকে বেশি আছে জীবনের ঝুঁকি। জীবনের থেকেও আছে মৃত্যু ভয়। একই বাতাস,একই গাছের পাতা,একই মাটির জল বয়ে যায় তারের এপার থেকে ওপারে। অথচ একটা পাখি যখন কোনোও দেশের সীমানা লংঘন করে। পূর্ব পারের বাদল মেঘ যখন কাটা তার পেরিয়ে কিমি দুই এগিয়েই অঝোরে বৃষ্টি ঘটায় -- তখন কোথায় যেন সব হারিয়ে যায় উত্তাল ঝরে। কখনও কাউকে কোনো জবাবদিহি করতে হয়না দেশের গণ্ডি পেরিয়ে যেতে। শুধু প্রশ্ন ওঠে আইনের খাতায়, আসামী বলে চিহ্নিত হয় আদালতের কাঠগোড়ায়। কিন্তু শুধুই কি এই আইনের ধারা নিয়ে দেশ শাসনের কাহিনি? আসলে তা হয়তো কখনোই নয়,তাইতো উত্তরের হাওয়া অনায়াসেই সীমানা পেরিয়ে পৌঁছে যায় ওপারের কুড়িগ্রামে। সাম্য বজায় রাখতে। ভালবাসতে। বুকে টেনে গান শোনাতে আবার সন্ধ্যে বেলায় ভাঙা আলোর রেখা ধরে ফিরে আছে পূরাণের কথা শোনাতে। যে গান তিনি গান, যে সুর আমার আপনার সবার হৃদয়ে বেজে উঠে সেইতো সাম্যপুরাণ।
এই পুরাণের কথা বলতে বলতে একটা কবিতার কথা মাথায় এলো। যদিও কবিতাটি কোনো কবিতার বইয়ের নয়। কবিতাটি আছে, একটি বইয়ের সূচনায়। এখানে পুরোটাই দিই—
কাশফুল
রেললাইনের ধারে মানুষের পিঠসমান কাশফুলের বন
টাইপরাইটার নিয়ে তার মধ্যে একজন বসে
একটা শালিখ নামল টাইপরাইটারে পুজোর আকাশ থেকে সাদা রং এক ঝাঁক মেঘও নেমে এল তাঁর মাথায়।
দূর দিয়ে চলে গেল ট্রেন...
ট্রেনে যেতে যেতে আমি স্বচক্ষে দেখলাম কাশবনের মধ্যে বসে সুভাষদা কবিতা লিখছেন। (জয়ের সুভাষ – জয় গোস্বামী/ দে’জ পাবলিশিং)
বইটির শুরুতেই কবি জয় গোস্বামী লিখছেন এই কবিতা। কী অসাধারণ একটা ছবি। একজন অগ্রজ কবির প্রতি তাঁর এই ধরনের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, এই রকমের সমর্পণ। কবিতার কী বিরাট এক চিন্ত্যক, দিকপাল, কবিতার অনন্য স্বর সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উদ্দেশ্যে জয় গোস্বামী লিখছেন এই একটি কবিতা। যে সুভাষ মুখোপাধ্যায় যাঁর কবিতায় আছে সজীবতা, আছে মায়ার গান, আছে বাদল মেঘের গম্ভীরতা। তাই তো একজন আদ্যন্ত কবির জন্য সময়ও অপেক্ষা করে থাকে, তাঁকে তার প্রাপ্য কাজে ফিরিয়ে আনতে।
আর যদি আমাদের বইটির দিকে তাকাই, তাহলে দেখব, এক অণুজ কবি, নাম সাম্য রাইয়ান তাঁকে উদ্দেশ্য করে বইটির ১৪ নং কবিতা।
কবি সুবীর সরকার লিখছেন তাঁর ১৪ নং কবিতায়—
“দৃশ্য দৃশ্যায়ন মুছে ফেলে সাম্য তার যাতায়াতের রাস্তায় বিছিয়ে দিতে থাকে ধনীবাড়ির খোলানের মস্ত এক মায়া। সেই মায়ায় নিঃশব্দে ঢুকে পড়ে মধ্যরাতের শহর কুড়িগ্রাম।
আর সাম্য রাইয়ান লিখে ফেলেন ভুরুঙ্গামারীর
রাস্তা”
আচ্ছা, নদী বিধৌত মাটির সজীবতা, সরলতা এসব কিছু নিয়েই কি সাম্যর জীবন নয়? আসলে তো এই তাঁর নিজের জীবন, নিজের প্রেম, নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনন্ত প্রশ্ন! কবি সুবীর সরকার সেই প্রশ্নের সন্ধানে পাড়ি দেন ওপার বাংলায়। ‘দৃশ্য দৃশ্যায়ন মুছে ফেলে...’ এই যে একজন কবির যাতায়াতের পথে যেটুকু দৃশ্যমান এবং এই দৃশ্যবস্তু অনায়াসেই কবি নিজের অজান্তেই রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে পারেন। সেখানে কোনো বেগ বা নিয়তির বাঁধা থাকে না। আর যে মাটি মেখে কবি সাম্য বড় হয়েছেন, যে ধুলো উড়িয়ে বিকেলের পড়ন্ত রোদ গায়ে মেখে শৈশব থেকে তরণের দিকে এগিয়েছেন সময়ের ক্ষণে, সেই সাম্যই তো পারেন মায়া দিয়ে, প্রেম দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে নিজের গ্রামের মাটি আঁকড়ে ধরতে। সেই অনুভূতি নিয়েই কবি সুবীর সরকার লেখনে, “... সেই মায়ায় নিঃশব্দে ঢুকে পড়ে মধ্যরাতের শহর কুড়িগ্রাম।” এই প্রকৃতি মায়া খুবই কঠিন, হৃদয়ে আঁকড়ে বসে নিজের জায়গাটুকু করে নিতে পারে। তাই তাঁকে নিয়েই কবিতা কথা বলতে, প্রথমেই তিনি বলেন—
বইটির ১নং কবিতায় তিনি লেখেন—
“সাম্য রাইয়ান তার দুই চোখ দিয়ে কেমন দূরাগত এক বিভ্রম কিংবা ভ্রম নিয়ে এই উত্তরদেশের উত্তর শিথানে প্রবাহিত নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল। সে কি নদীজলপ্রবাহ দেখে আদতে কিঞ্চিৎ আনমনা হয়ে পড়ছিল!...”
আচ্ছা এই এক জীবনের দৃশ্য দেখে নেওয়া অন্যের চোখ দিয়ে। প্রবাহমান নদীর গতি যেভাবে মানুষের জীবন ও জাতির সমাজ এবং রাষ্ট্রজীবনকে প্রভাবিত করে, ঠিক তেমনই সেই প্রবাহ উপলব্ধি করতে পারেন সাম্য। তাঁর নিঃশব্দ অনুভব কোথাও এক গানের সুরের মতো শান্ত ও সমাহিত। তাই কবি সুবীর সরকার বলতে পারেন, মনের কথা, উপলব্ধির কথা।
বইটির তিন নম্বর কবিতা—
“এই গান এই বুকের ভেতর হাহাকার তৈরি করা সুর এই নদী এই নৌকো এই প্রায় সন্ধ্যাকাল নিয়ে এই উত্তরদেশের বুকের মধ্যে জেগে উঠতে থাকে এই অতিপ্রাকৃত মহাজগৎ, যেখানে প্রাচীন প্রবাদের মতো ক্রমে জায়মান হয়ে উঠতে থাকেন কবি সাম্য..” আচ্ছা এই কবিতা পড়লে কি সত্যিই মন আনন্দে ভরে ওঠে না? নদীর বুকে বাঁধা নৌকা আর সূর্যাস্তের আলো-আঁধারির সন্ধ্যাবেলার হিমেল হাওয়া, এই তো একজন শিল্পীর শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। আর এই জীবনের বাইরের যে অদৃশ্য জীবনের হাহাকার বা অতিপ্রাকৃতর আয়োজন, যেখানে স্বেচ্ছায় সহজে পৌঁছে যাওয়া যায় না, দৈবাৎ সেখানে পৌঁছে যেতে হয়। সেই প্রাচীন মানুষের দিনযাপনের কাহিনী শুনে বড় হতে থাকে কোনো আগামীর ছোট্ট শিশু। তাই তিনি অনির্দেশের উদ্যেশ্যে যাত্রা করতেই পারে। কবি সাম্য যেমন মাটির রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকেন, কবি সুবীরও তেমনই শরীরের মন্থর গতি নিয়ে এক কালখণ্ড অতিক্রমের স্বপ্ন দেখেন। যার জন্যই তিনি তাঁর ছয় নম্বর কবিতায় লেখেন এই বিচিত্র হাঁটতে থাকার আকস্মিক অভিজ্ঞতা।
বইটির ছয় নম্বর কবিতা—
“সাম্য রাইয়ান হাঁটতে থাকে। তাকে তো এভাবেই হেঁটে যেতে হয়। তার শরীরের ছন্দে মাঝে মাঝে মন্থরতা
এসে গেলে সে নিজেকে তামাক বাড়িতে গান গাইতে থাকা, নাচ করতে থাকা পুরনো কালখন্ডের
নাচুনিদের কথা মনে করে। তার শরীর অধিগ্রহণ করে নেয় গান আর গান, যার সুরের দাউদাউ আগুনে জীবনভর…”
কবি সাম্য সম্পর্কে বেশ কিছুদিন আগে তারই ভূমিকায় লিখেছিলাম— গানের মায়া। গানের খেলা। গানের কথা। প্রেমের বাঁধন নিয়ে শুধুমাত্র সামনেই এগিয়ে যাচ্ছেন সাম্য। এই যে ‘পাগল’, সে তো সাম্যের নিজের প্রতীক। এই পাগলামি আছে নৈঃশব্দ্য জীবনে নিস্তব্ধতার মতো। জীবনের সবটুকু অপরাধ মুছে যাক পাখির ডানা মেলাতে, লাগামছাড়া জীবন পাক আবছা নীলের আভা। এই নীল তো জীবন। বিরাট নীলের সাগরে আছে একটা ছোট্ট নৌকা। সেও জীবন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পারে। আমরা সেই নৌকার পালে পাগল হাওয়া তুলে দেব। আসলে সাম্য জানে মানুষকে ভালোবাসার গোপন কৌশল। কতটা প্রেমে মানুষ নিজেকে হলুদ বনে ছড়িয়ে দেবে। তাই সমস্ত স্মৃতি সাম্যের কাছে গভীর হলেও কখনও বেদনাদায়ক নয়। আমরা যেটুকু জীবন নিয়ে আঁকড়ে আছি, যেটুকু মুক্ত বায়ু পাওয়ার তাগিদে বেরিয়ে পড়েছি সকালের রোদে, যেটুকু আশ্বাস নিয়ে চাঁদের কলঙ্ক লেপেছি আমাদের শিশুদের কপালের শুভ ভাগ্যের আশায়— সাম্যও সেই অনালোচিত— অবর্ণিত খামখেয়ালিপনায় আমাদের ভাসিয়ে দিয়েছেন তাঁর হলুদ পাহাড়ে। এই পাহাড়ের গায়ে রোদের আলো এসে ঠিকড়ে পরে, এই পাহাড়ের গায়ের মাটি পড়ে ফেলে সবুজ ঘাসের পোশাক, এই পাহাড়ের মাথায় নীল আকাশে গায়ে থাকে মেঘ। এই মেঘের কোলে নাচে বিদ্যুৎ। আমরা আষাঢ়ের বর্ষা আসার প্রতীক্ষায় বসে থাকি পাহাড়ের টিলায়। এই পাহাড় বানিয়েছেন রূপকার সাম্য। এই বিশ্ব রাজনীতির বাইরে মানুষের হাতে ফুল দিয়ে হাতকড়া পড়িয়েছেন সাম্য। নির্বাসন দিচ্ছেন তাঁর সদা চঞ্চল ও ওই হাসি মুখে পাহাড়ের কোলে। যাঁর নাম হলুদ পাহাড়। তাহলে এই হলুদ পাহাড়ের কবি কীভাবে মহানগরের পথে পা বাড়াবে? মাটির আলো, মৃদু বাতাস, নিশ্চয়তার শিলালিপি সবই তো কবি সাম্য নিজের মতো করে প্রত্যক্ষ করেন। তাই মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে তিনি সন্ধান পান ‘এক চিরায়ত পৃথিবীর’ যেখানে মানুষের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। অথচ কবি সাম্য উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে থাকেন নদীর মধ্যে গঙ্গায়। যেখানে চরের মানুষ বসবাস করেন।
তাই সুবীর সরকার এ বইয়ের দশ নম্বর কবিতায় লেখেন—
“এই এই মাঠ প্রান্তর গহিন চরাঞ্চল জুড়ে কেবল গান আর গান। কোথাও অদৃশ্য বাদ্য ও বাজনার ঘোর। চরের অন্দরে কন্দরে এক চিরায়ত পৃথিবীর নবজন্ম হয়। মানুষের জন্ম মরণ নিয়ে কী অদ্ভুত বেঁচে থাকা! বেঁচে থাকবার পরিসর জুড়ে জুড়ে জীবনের বহমান প্রবাহে শরীর ডুবিয়ে দেয় সেই কবেকার জোড়া মহিষ। তখন মাথায় বহুবর্ণ গামছা জড়িয়ে সাম্য রাইয়ান হেঁটে যেতে থাকে তালুক মুলুক আর নয়া কোন জেগে ওঠা চরের দিকেই।”
তাই গতিময়তায় বিশ্বাস রেখেই তিনি নতুন পথের সন্ধানে ফিরতে চান।
(২)
কবিতা বলার ধরণ সবসময় কবির আত্মচেতনা ও জীবনের এক বড় অভিজ্ঞতা থেকে সঞ্চিত হয়। আমরা কবিতায় ঠিক তেমনই দেখে আসছি। আমাদের এই বই সাধারণত অন্যান্য বইয়ের মতো নয়। এই বই মূখ্যতই একজন কবির জীবন যাপন ও তাঁর সামগ্রিক জীবনের খণ্ড চিত্র। তাঁর জীবন গঠনের নানা দিক, পথ পরিবর্তনের কাহিনি।
প্রায় শুরুর কিছু কবিতা লেখার পর,তিনি চার (৪নং) কবিতায় লিখছে—
“ঘোড়াডাঙার মাঠ পেরিয়ে যেতে যেতে, গরুজলখাওয়া ঘাট অতিক্রম করতে করতে, ডাকাতিয়ার বিল ছুঁয়ে ছুঁয়ে সাম্য তার স্বপ্নের শাখা-প্রশাখাকে কখন কীভাবে যে ডানা মেলা পাখির বিস্তৃতি দিতে শুরু করে সেটা কিন্তু কেউ বুঝতেই পারে না।
অথচ সাম্য একটানা তাকিয়ে থাকেন হলুদ পাহাড়ের
দিকে…”
এই কবিতাটি বড়ই আশ্চর্যের। একটি বড় গ্রামের ছবি আঁকেছেন কবি তাঁর শব্দ আর জীবনবোধ দিয়ে। এই প্রসঙ্গে একটি কথা মনে পড়ছে। বাংলাদেশে প্রখ্যাত লিটল ম্যাগাজিন ‘বিন্দু’। মূলত সেই পত্রিকার সম্পাদক সাম্য রাইয়ান। এই বই পরিকল্পনার আগে আমার ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশ যাবার কথা চলছিল। এমন সময় জানলাম উত্তরের কবি সুবীর সরকার যাচ্ছেন বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম। ফোনের ওপাশ থেকে সাম্যদা বলছেন— ‘আমরা এখানকার মানুষ হয়ে যত বেশি না কুড়িগ্রামকে চিনি তার থেকেও সুবীরদা খুব খুব ভালো চেনেন।’ সেই থেকেই কবি সুবীর সরকারের প্রতি এক অদম্য সম্পর্কের আত্মীয়তার অনুভূতি মনে মনে বুঝি। আর তাই সহজেই কবিতার মধ্যে বিরাট জনজীবন, মাঠের পর মাঠ, দিগন্ত দেখার যে স্বাদ আমরা তাতো সহজেই দেখতে পাই। “ঘোড়াডাঙার মাঠ পেরিয়ে যেতে যেতে, গরুজলখাওয়া ঘাট অতিক্রম করতে করতে,” –আলোচ্য লাইনটি খুব গ্রাম্য ময়তার রূপ। এই যে ঘোড়াডাঙার মাঠ পেরিয়ে যেতে যেতে, গরু জল খাওয়া ঘাট কখন সাম্য পার হতে যায়। আসলে কবিতার কথা মানে তো জীবনের কথা। এক কবির গ্রাম্য জীবনের কত চিত্র ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা তিনি জানার চেষ্টা করেছেন। আর এই দুইধারের প্রকৃতির দামামা দেখতে দেখতে কবি সাম্য যাচ্ছেন তাঁর নিঃশব্দ ও নিস্তব্ধ পাহাড়ের কোলে, নাম যার হলুদ পাহাড়। এই যাওয়ার কথা লিখতে লিখতে একটা ছোট্ট ঘটনার কথা মনে পড়ছে। আমি তখন ছোট। আমাদের শহর থেকে প্রায় আঠারো কিলোমিটার দূরে আমাদের গ্রাম। নাম দোগাছি। জনশ্রুতি আছে এইখানে নাকি দুটি গাছ ছিল। এখন কালের নিয়মে সেই গাছ না থাকলেও থেকে গেছে নাম। সেই দোগাছি যেতে গেলে নামতে হতো ঈদগাহ মোড়ে। সেখান থেকে বাড়ির গরুর গাড়িতে করে আমরা গ্রামে আসতাম জমির আল ধরে। প্রায় তিন ক্রোশ রাস্তা পেরিয়ে আমরা আসতাম ইস্কুলডাঙার মাঠ। এই মাঠ থেকে একটা রাস্তা উত্তরের দিকে চলে গেছে। একটি রাস্তা পশ্চিমে আরও একটি দক্ষিণে, আমরা ঢুকছি পূর্ব দিক দিয়ে। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত আমরা গ্রামে থাকতাম বছরের তিন থেকে চার মাস তাও আবার ঠাকুরের পালির জন্য। সেই থাকাকালীন আমরা প্রায়শই সেই উত্তরের রাস্তা ধরে যেতাম পীরতলা বলে একটা ছোট্ট পাহাড়ের দিকে। ওখানে যাওয়ার রাস্তা বেশ অদ্ভুত। দুদিকে উঁচু উঁচু দেয়ালের মতো ছোট ছোট ঢিবি। আমি ঢিবির ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে যেতাম। হাতে একটা কঞ্চি নিতাম। কিছু ঝোপ জাতীয় গাছে কঞ্চি চালাতে চালাতে যেতাম। আর পূর্ব পারে থাকত বেশ বড় পাহাড়ের মতো উঁচু ঢিবি। ওখানে অনেকের গরু পাহাড়ের গায়ে চড়তো। মিহির দা বলে একজন থাকতেন আমাদের গ্রামের বাড়ির উলটো দিকে। ওইই গরু-ছাগলের পাল নিয়ে, সন্ধ্যের কালো আকাশ নিয়ে বাড়ি ফিরত। আমরা দেখতাম। আর দেখতে দেখতে সেই পিরতলায় পৌঁছে যেতাম। ওখানে দেখার মতো বলতে জনশ্রুতি ছিল, হুসেনের সমাধি। তার সেই প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ। ওখানে ছোট ছোট হাতি, ঘোড়ার মূর্তি পাওয়া যেত। আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে সংগ্রহ করতাম, পাছে কেউ জানতে না পারে। আর সেই পীরতলার পাশেই ছিল একটা দিঘি। তখন দেখতাম দিঘির জলে অস্তগামী সূর্যের রক্তাভ আভা। এভাবেই গ্রামের বিকেল গুলো মাঝে মাঝে কাটত। এখানে কবি লিখছেন— “সাম্য তার স্বপ্নের শাখা-প্রশাখাকে কখন কীভাবে যে ডানা মেলা পাখির বিস্তৃতি দিতে শুরু করে সেটা কিন্তু কেউ বুঝতেই পারে না।” –আসলে এই মাটির সঙ্গে মিশে থাকতে থাকতে সাম্যরও কোথাও যেন চিন্তার স্মৃতি বিস্তার পেয়েছে। তাই শাখা প্রশাখার মতো কখন সেই ভাবনা উড়ে গেছে সন্ধ্যার আকাশে।
তিনি আট নম্বর কবিতায় বলছেন—
“উজানের দিকে তাকিয়ে কী দেখে সাম্য! সে কি তার চোখের মুখের পেশীর তরঙ্গ দিয়ে এক ঝাঁক পাখিদের উড়ে যাবার দৃশ্যের কাছে খুব মন্থরলয়ে
এগিয়ে যেতে চাইছে! উজান আকাশে কি মেঘ জমেছে! না কি ধুলোর ঘূর্ণি ছুটে আসতে চাইছে সেই উজান দেশ থেকেই” –আসলে এই উজান মানেই তো আগামীর জন্য বিরাট ভাবনা ও প্রয়াস। চোখে মুখের পেশী তরঙ্গ সাম্যকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় বাদল মেঘের আসমানে।
আবার—
কুড়ি নম্বর কবিতায় লিখছেন—
“নাগেশ্বরীর রাস্তা থেকে পান-সুপারি নিয়ে
শরীরভর্তি আলো মেখে
কবি সাম্য রাইয়ান ফিরে আসছিল
জীবন ও উৎসবের ভেতর।”
এই কবিতায় এই যে ‘জীবন ও উৎসবের ভেতর’ শব্দ দিয়ে তিনি লিখছেন কবিতার আঙ্গিক, লিখছেন বাস্তব জাদুবিদ্যার তন্ত্র। এই আলোর আলেয়া মেখে নিয়েছে সাম্য তাঁর নিজের গায়ে। পরিণামদর্শী, স্বাধীনচেতা এবং কবিসুলভ এক অপার আনন্দের নাম সাম্য রাইয়ান। যিনি পরিভ্রমণ করেন নিজের গ্রাম, মাটি, জল, বাতাস আর সেই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে।
সবশেষে বলি, এভাবেই তিনি সাম্য পুরাণ গাঁথেন পাঠকের জন্য। এক ধারাভাষ্যকার এর ভূমিকায় তিনি নিয়ে উপস্থিত করেন ওপার বাংলার কবিময় সত্তা সাম্য রাইয়ানকে। এভাবেই ছোট্ট স্বপ্নের আদলে তিনি নির্মাণ করতে পারেন স্থানহীন স্থানাঙ্ক। যা আপামর বাংলা কবিতা প্রেমী পাঠকের কাছে বিশেষ সমাদৃত হবে। তাই কবি সুবীর সরকার লেখেন—
“এই এই মাঠ প্রান্তর গহিন চরাঞ্চল জুড়ে কেবল গান আর গান। কোথাও অদৃশ্য বাদ্য ও বাজনার ঘোর। চরের অন্দরে কন্দরে এক চিরায়ত পৃথিবীর নবজন্ম হয়। মানুষের জন্ম মরণ নিয়ে কী অদ্ভুত বেঁচে থাকা! বেঁচে থাকবার পরিসর জুড়ে জুড়ে জীবনের বহমান প্রবাহে শরীর ডুবিয়ে দেয় সেই কবেকার জোড়া মহিষ। তখন মাথায় বহুবর্ণ গামছা জড়িয়ে সাম্য রাইয়ান হেঁটে যেতে থাকে তালুক মুলুক আর নয়া কোন জেগে ওঠা চরের দিকেই। তার দু চোখের মণিতে তখন জীবনের খুব মায়া খুব নিবিড় হয়ে জায়মান থাকে। আর তাকে জড়িয়ে ধরে হাজার বছরের কী এক সুতীব্র আলো। সেই আলোর ভেতর আমরা দেখে ফেলি উজান দেশের রঙ্গিলা সব পাখপাখালিদের যারা ভোরের আলোর ভেতর ফিরে আসতে থাকে একটা ১৬ নদীর দেশে।”