❑ সব্যসাচী মজুমদার
বাংলা কবিতা লিখতে যারা দু’হাজার দশ পরবর্তী সময়ে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী তরুণ সাম্য রাইয়ান তার বই ‘লিখিত রাত্রি’তে গড়ে তুলতে চেয়েছেন একটা দৃঢ় ও তীব্র গতিময় অবস্থান। একজন কুশলী গায়ক যেন বিস্তারে ক্রমশঃ ব্যপ্ত হয়ে চলেছেন, এমন ভঙ্গিতে সাম্য লেখেন,
“ভূগোল ক্লাসের স্মৃতি ভুলে গেছি তমোগুণে! মধ্যরাতেকিচ্ছু মনে পড়ছে না কোনও মতে, যেন স্মৃতিখণ্ড জমা নেইকোথাও; নির্জনে ডাহুক ডাকে নাই বুঝি সারাংশ সমেত।”
এক.
সবিস্ময়ে লক্ষ করি সুর ও শব্দের নিপুণ যোজনা তরুণকে দিয়ে ‘নাই’ শব্দটি ব্যবহার করিয়ে নিল। একটি ‘ই’-এর ওপর ভর করে থরথর করে উঠলো সমস্ত হাহাকার—
“...মৃত শরীরের স্মৃতিবাহীসকল জাহাজ জেগে উঠুক মানুষ মেশিনেরঅযৌন শিঁরদাঁড়ায় টিক টিক ঘণ্টা শব্দ হয়ে।”
তিন.
পাঠক, বাংলা কবিতার আরেকটা কারুবাসনা আপনার সামনে জেগে উঠছে। লক্ষ করতেই পারছেন তীব্র হয়ে উঠেছে ভাষা, উক্তি সরাসরি বিদ্ধ করছে আপনাকে। কথা বলছে পাঠকের সঙ্গে—
“সাপের ঝাঁপির মতো যে ঘরটিতে আমি থাকিতার পশ্চিমে একটা আকাশমুখী জানলা আছে।ঘরের একমাত্র যাত্রী হিসেবে আমি প্রতিদিনসেই জানলা দিয়ে জিরাফের মতো গলা বার করি।”(লিখিত রাত্রি–নয়)
ঘরের একমাত্র যাত্রী আর জিরাফটি যে গলা বার করছে আমাদের পাঠস্মৃতির এবং স্মৃতি বিশ্বাসের বিনির্মাণ করে। যাত্রী, জিরাফ আর ঘর- তিনটি মৌলিক প্রেক্ষণবিন্দু পরষ্পরের সঙ্গে অবস্থান বিনিময় করে আসলে আমাদের পাঠস্ক্রিয়ায় যে ছবিটা গড়ে তুলছে তা দেখার জন্য আমরা হয়তো প্রস্তুত ছিলাম না।
সাম্যের কবিতা রোমান্টিক অবসেশন থেকে বেরিয়ে রোমান্টিক রিয়ালিটির বিভিন্ন পরিক্রমাকে তুলে ধরে বলে মনে হয়। অন্ততঃ ছাপ্পান্নটি ছোটো কবিতায় নির্মিত বর্তমান কাব্যটি নিঃসন্দেহে এই প্রতীতির সাক্ষ্য দেবে,
“...দেখছি ডানাঅলা একমাথার আকাশে সুর তুলে উড়ছে।”(লিখিত রাত্রি–একত্রিশ)
বাস্তবের বিবিধ রূপ তৈরি হতে থাকে আর আমরা দেখি যাদু, অপর বাস্তবের তীব্র নিখাদে বেজে ওঠার বাসনা। একই পরম্পরায় রচিত শিরোনামহীন কবিতাগুলো নিঃসন্দেহে একটা নতুন অতিক্রমের দিকে নিয়ে যায়।
সাম্য রাইয়ানের কবিতা পাঠ করে আপনি এই সত্য স্বীকার করতে বাধ্য যে বাংলা কবিতা এই ডিসটোপিয়ায় এখনও লিরিক প্রবণতায় বিশ্বাস রাখছে। এই আলোচকও বিশ্বাস করে বাংলা কবিতার নিজস্ব অর্জন এই প্রবণতা। কেউ তাঁকে এড়িয়ে অর্জন করতেই পারেন বিকল্প ভূগোলে নির্মিত প্রবণতা। কিন্তু প্রতিবেশকে যাপন না করলে কি আর সেই প্রতিবেশে তৈরি কাব্য প্রবণতায় সম্পৃক্ত হওয়া যায়? সন্দেহ থাকে। সেই সঙ্গে ভরসা থাকে যে ছন্দ এবং লিরিক আরও উন্নততর কবিতা মাধ্যমে পরিণত করবে বাংলা কবিতাকে। সাম্য রাইয়ান লিখছেন,
“দেখো পুরোটা জুড়ে শুধু ছেঁড়া পাতা ফুল পড়েছিলো যা। সকল খারিজ হলো অন্ধ বাগান থেকে।”(লিখিত রাত্রি–উনপঞ্চাশ)
সাম্য কুয়াশার যাদু মিশিয়ে বিচিত্র করে চলেছেন আসলে বাংলা কবিতাকেই। নির্মাণ-প্রতিনির্মাণে ওঁরা বলে চলেছেন এই উত্তর মহামারি পৃথিবীর ভাষা। সমস্ত মানচিত্র থেকে উঠে এসেছে সেইসব অক্ষর। সাম্য লিখে রাখছেন,
“ভুল জায়গায় সঠিক বাক্যফুল ফুটতে দ্যাখোনি কেউ।”(লিখিত রাত্রি–একান্ন)
আসলে সাম্য এমন একটি সময়ের মানুষ, যে সময় সময় বাস্তবিক থেকে ক্রমশঃ জায়মান হয়ে উঠছে। ক্রমশঃ তার রিয়েলিটিকে বদলে আরবান স্তরন্যাস করছে আর সেই স্তরের একদম প্রান্তিকবর্গ থেকে উঠে আসছে বিধ্বস্ত পৃথিবীর আরেক যাপন কথা। সেই পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল কেবল ‘ভোগ’ শব্দটির পারস্পরিক সম্পর্কের সূত্রে। কোনও যোগাযোগের সম্ভাবনাও ছিল না বোধহয়। তাই প্রস্তুতিহীন আমাদের হতচকিত লাগছে জায়মান নতুন পৃথিবীর রূপকে দেখে। ভীষণ চমকিত একটা প্রহর কাটাচ্ছি কাটিয়ে ওঠার দুর্মর বাসনায়। আর সেই বাসনার তাগিদেই যেন সাম্য লেখেন,
“উফ কী গাঢ় বিভক্ত রাত, কী নির্লজ্জ দলাদলিঝিম ধরা শেষে শূন্য বোতলের ভৈরব, গলাগলিসর্বত্র এত বিষ-বিষময়, পুনরায় ধুয়েমুছেসাফসুতরো করতে হবে আমাকেই...”(লিখিত রাত্রি–ছাব্বিশ)
একটা অল্টার সভ্যতার কিংবা বিকল্প নির্মাণের দিকে যেতে চায়, কিন্তু পূননির্মাণ আর প্রতি-নির্মাণের ভেতর নির্ণয় করে উঠতে পারেনি পরবর্তী নির্ভরকে। তাই একই সঙ্গে সাম্যের রচনায় যেমন লিরিক প্রবণতাকে নস্যাৎ করা যায় না, একইসঙ্গে ডিসটোপিয়ান ভাষাও স্বরবিন্যাস করে। তারই সম্মিলিত বিশ্বাস স্বরবিন্যাস ঘটায় এই গ্রন্থে,
“বৃথা নদীজন্ম, কৈশোর সেতু, সোডিয়াম আলো;আমাদের কথা কেউ ভেবেছে, যারা ঘুমিয়েছে?” (লিখিত রাত্রি–উনত্রিশ)