হালকা রোদের দুপুরে আমরা রহস্যময়তার পথ ধরে

❑ হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় 

খুব ছোটবেলায় যখন মায়ের হাতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ার অভিনয় করতাম আর খেয়াল রাখতাম মা কখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন দুপুর আমায় নেশার মতো টানত। গভীরভাবে লক্ষ্য করে যখন দেখতাম মা ঘুমিয়ে পড়েছে তখন আস্তে আস্তে মায়ের হাতটা আমার গা থেকে সরিয়ে দিয়ে একছুটে একেবারে আমগাছ তলায়। দেখতাম একটি কি দুটি বন্ধু আমার আগেই সেখানে হাজির হয়ে গেছে। এরা আমার দুপুরবেলার বন্ধু। বলাই বাহুল্য সকাল ও বিকেলের বন্ধুর থেকে এরা একেবারে ভিন্ন চরিত্রের। শুধু তাই নয় এদের প্রতি আমার দুর্বলতাও ছিল অনেক বেশী। শুরুতেই এতগুলো কথা বলার একটাই কারণ— সাম্য-র আমার চেয়ে বয়সে অনেকটা ছোট হলেও দুপুরকে সামনে রেখে তার সঙ্গে আমার একটা গভীর যোগ আছে বলে আমি অন্তত মনে করি।

বাংলাদেশের অমর একুশে বইমেলা ২০২৩-এ প্রকাশিত হয়েছে সাম্য রাইয়ানের “হালকা রোদের দুপুর”।  না, বইটি এখনও হাতে পাইনি তবে সাম্য বেশ কয়েক মাস আগে এই কাব্যগ্রন্থটির বেশ কয়েকটি কবিতা ফেসবুকের বন্ধুদের জন্য পোস্ট করেছিল। সেখান থেকেই আমার পড়ার সুযোগ হয়। এছাড়া কয়েকটি অনলাইন পত্রিকাতে এবং “ছায়াবৃত্ত” প্রতিদিনের কবিতার পাতায় “হালকা রোদের দুপুর”-এর বেশ কিছু কবিতা পড়ে ফেলি। খুব বেশি হলে সাম্য হয়তো বছর দশ বারো লিখছে কিন্তু এরই মধ্যে তার একটা নিজস্বতা তৈরি হয়েছে। শুধু তাই নয়, সে আমাদের মধ্যে অনেক আশা জাগিয়েছে। যেমন এই কবিতাটি আমরা “হালকা রোদের দুপুর” থেকে সামনে আনতে পারি, “যৌনতা, তাহলে ফিরে এলে গতিহীন সাইকেলে! কেমন দেখলে জীবন, কেমন ছেলেমেয়ে, যুবক-যুবতী! বসন্তের দিকে তাকিয়ে ওরা অহেতুক হাসিত্যাগ করে। নিশ্চুপ ধ্যানবিন্দু ভেদ করে পৌঁছনো যায় না সরোবরে? মিথ্যা আকাশের প্রতি টান ছিলো। বুঝিনি তীব্র ঝড়ের সংকেত। নকল নদীর প্রতি টান ছিলো। “ঝাউগাছ কই পাই?” বলে ওঠে টনটনে রোদ। কিছুটা পেরিয়ে যায় নিশ্চুপ বালুর দুপুর। নকল নদীর পাশে আসল ঝাউ-য়ের বন— চিত্রকল্প ভাবো দামোদর, ব্যক্তিগত চিত্রকল্প ভাবো।” সাম্যর কবিতা মাটির এমন এক গভীর প্রদেশে অবস্থান করে যেখান থেকে সে বলে উঠতে পারে “কেমন দেখলে জীবন, কেমন ছেলেমেয়ে, যুবক-যুবতী! বসন্তের দিকে তাকিয়ে ওরা অহেতুক হাসিত্যাগ করে। নিশ্চুপ ধ্যানবিন্দু ভেদ করে পৌঁছনো যায় না সরোবরে? মিথ্যা আকাশের প্রতি টান ছিলো। বুঝিনি তীব্র ঝড়ের সংকেত।” সাম্য এই কবিতা পড়লে মনে হয়, সে হাতুড়ি ছেনি দিয়ে পাথর থেকে প্রাণ বের করে নিয়ে আসছে। তাই তার কবিতা যত এগোয় ততই তার রূপ পরিবর্তিত হতে থাকে।

“হালকা রোদের দুপুর” কাব্যগ্রন্থের আরও একটি কবিতা— “বসন্তের কোকিলটা গেল কই? সময়ের প্রতি সে ব্যাপক শ্রদ্ধাশীল। পিরিয়ড ফুরাইলে তার যথাতথা ডাকাডাকি নাই। অদেখা বাগানের কোলঘেঁষে, আমি বিরক্ত বহুৎ, দেখি এপ্রিলের ঝড়! আগুনের সামান্য পুঁজি, অথচ অনেক সিগারেট। —চলে যাও শৌখিন শিকারীর সাথে, যদি কিছু বন্দোবস্ত হয় মৎস্যশিকারের। অথবা বাদ্যযন্ত্র আনো। সে-ও খানিক কাজ। ঝুমঝুমিয়ে আনন্দযজ্ঞ করো। একদিকে মন্দিরার কাম, অন্যদিকে ভীষণ উচ্ছাস। দমকা হাওয়া নেই। অনুশোচনায় ডুবে যাচ্ছে কোকিলের গান।” অদ্ভুত এক সময়ের মানচিত্র এঁকেছে সাম্য। কোকিল যেন সেই যথার্থ সময়ের প্রতীক। সময়ের এমনই এক পথ ধরে তার হেঁটে চলা, যেখানে সময় থেকে সরে গেলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনই এক নির্ধারিত সময় এবং তার দায়বদ্ধতা যে, তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারার কারণেই আসে বিরক্তি। অন্যদিকে শৌখিন মৎস শিকারীর যে সাজানো বন্দোবস্ত সেখানে দমকা হাওয়ার কোনো পরীক্ষা নেই। তাই অনুশোচনায় ডুবে যায় কোকিলের গান। অসাধারণ এক দক্ষতায় কবি যে সময়ের চিত্র এঁকেছেন তা আমাদের সর্বক্ষণের বিচরণের আকাঙ্ক্ষিত ক্ষেত্র।

দুই                                                                                                                  গতবছর ঠিক এইসময় অমর একুশে বইমেলায় সাম্য-র যে কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় তার নাম “লিখিত রাত্রি”। এই যে দুপুর রাত— সারাটাদিনের বিভিন্ন সময় জুড়ে কবি যেন তার নিজের পৃথিবীলোকে বিরাজ করছে। এ বোধহয় কবির পক্ষেই সম্ভব। সনয়ে সময়ে তার রঙ বদলে বদলে যায়। যেমন এই কবিতাটির দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাব—

“শেষমেশ দুর্বিনীত হতে হতে হতে হতে আমি
স্পর্শকাতর রাত্রির ঘ্রাণ আবিষ্কার করলাম।
যা ছিল আসলে প্রকৃত; নিষিদ্ধ সুরের মধ্যে লীন।
পুরোনো সঙ্গীত থেকে যারা জন্ম নিয়েছিল; তারা—
তাদের গন্ধ অনুভব করে শুধুই সুরেলা হৃদয়।”

সাম্য আমাদের সামনে মেলে দিল রাত্রির এক অভিনব সংজ্ঞা। বহির্জগতের কাছে যা দুর্বিনীত সেটাই আসলে প্রকৃত বিনীত। তা না হলে স্পর্শকাতর রাত্রির ঘ্রাণকে তুলে আনা যায়— এ তো চূড়ান্ত নিবেদন। আর এই নিবেদন যথার্থ বলেই পুরানো সঙ্গীতের মধ্যে যার জন্মসূত্র নিহিত তাকেই হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারে সুরেলা হৃদয়। অসাধারণ এক কবিতার জন্ম দিল সাম্য। আরও এক রাত্রি সাম্য আমাদের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। তবে এখানের অন্ধকারকে আমরা শুদ্ধতার এক চূড়ান্ত  স্তরে উন্নীত হতে দেখি। এই অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে যেন এক আলাদা শিক্ষা হয়। বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা মানে নিত্য নৈমিত্তিক অস্তিত্বের গ্লানি অন্ধকারের শুদ্ধতাকে নষ্ট করে দেয়। তাই তো কবির মনে হয় বাড়িটাই যদি এগিয়ে আসত তাহলে আরও ভয়ঙ্কর ঝড়-বাদলের রাতও শোভন প্রেমে কাটিয়ে দেওয়া যেত অন্ধকারের শুদ্ধতাকে হাতিয়ার করে—
“চারদিকে রোজ ঘন হয়ে ফোটা অন্ধকার পেরিয়ে
আমাকে বাড়ি ফিরতে হয়। আর এর মাঝে যদি
এরকম হতো, বাড়িটাই আসতো আমার দিকে
তাহলে এর অধিক, ঝড়-বাদলের রাতও
কী সুসজ্জিত শোভন প্রেমে কাটিয়ে দেয়া যেত!”

তিন
সাম্যর লেখা আরও একটি কাব্যগ্রন্থ “হলুদ পাহাড়” আমার খুবই প্রিয়। সাম্যর লেখার মধ্যে একটা তীর্যক ভাব প্রায় সবসময়েই বিদ্যমান। আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের ছোট ছোট গদ্যকবিতাগুলি আমাদের চারপাশের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা থেকেই উঠে আসা। কিন্তু তা হলেও আজকের সময়ের যান্ত্রিক মানুষগুলোকে সে ছেড়ে কথা বলে না। আসলে আজকের সভ্যতায় বসবাসকারী মানুষের এই অবনমন কবিকে মানসিক ভাবে পীড়া দেয়। যেমন ‘জোকার’ কবিতাটিতে—
“এক ধরনের বোকা বোকা দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাচ্ছি। তীব্র শব্দে দীর্ঘ বিরতি নিয়ে আওয়াজ আসছে।                                                                                                                  আমার বুক কেঁপে ওঠে। শরীরে নাড়া দেয় ।                                                                গতজন্মে কারা যেন আতঙ্কবীজ পুঁতে দিলো; আমার কিচ্ছু মনে নাই। সেই থেকে বেড়ে উঠলো, তার লকলকে ডগা গজালো। আমার কোনও স্মৃতি জাগলো না; না প্রেমের, না কামের।                                                                                                               আমি সেই জন্মবধির, পুরোনো ভঙ্গিতে পোষা দুঃখগুলো খাঁচা থেকে বের করে ময়দানে খেলা দেখাই।”

কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতাটিতে কবি মানুষের দিকে ঘুরে আঙুল তুলেছে— “ভাবছি, কাউকে বলবো একটা পাহাড়ের ছবি বানাতে। হলুদ পাহাড়, তার উপরে মেঘ, শাদা শাদা মেঘ। দূর থেকে দেখে গাদাফুল ভেবে ভ্রম হবে মানুষের।                                                                 ওরা খুশি হবে। মানুষ ভ্রমে প্রকৃতই আনন্দ পায়। পাহাড়ে উঠবে সকলে। কেউ কেউ পকেটে কিংবা পাটের ব্যাগে ভ্রমের আনন্দ ভরবে।                                                                  কিন্তু হলুদ পাহাড়ে হৈ-হুল্লোর নিষেধ।”

প্রথমেই শুনতে পাই, কবি কাউকে বলবে, কেউ যেন তাকে একটা পাহাড়ের ছবি বানিয়ে দেয়। অর্থাৎ উন্নত সভ্যতায় এজজন পাহাড়প্রেমীকে তার মনের মতো পাহাড় বানাতে হয়। কিন্তু কেন? তিনটি লাইনের দিকে দৃষ্টি দিলেই আমরা সব উত্তর পেয়ে যাব— “মানুষ ভ্রমে প্রকৃতই আনন্দ পায়” এবং আর দুটি হল “কেউ কেউ পকেটে কিংবা পাটের ব্যাগে ভ্রমের আনন্দ ভরবে। কিন্তু হলুদ পাহাড়ে হৈ-হুল্লোর নিষেধ।”

আরও একটি কবিতা “আশ্রয়দাতা”। চিরকালীন মায়ের এক ছবি অসাধারণ দক্ষতায় এঁকেছে কবি— “এক নির্বিরোধ মা দেখেছি আমি; হাওয়ায়-ছন্দে দুনিয়া সাজাচ্ছেন! সূর্যের ছাপ মারা মুখ তাঁর, শুধু একজন, পুরো পৃথিবীকে আশ্রয় দিচ্ছেন। এক করে করে বহুবার, প্রচণ্ড আলোর থাবা থেকে ছায়ার আঁচল পেতে চান করাচ্ছেন।”

সাম্য রাইয়ানের কবিতা স্বতঃস্ফূর্ত এবং রহস্যময়। অনেক জায়গাতেই মনে হয় একটা কুয়াশার আস্তরণ আছে। এই কুয়াশা ভেদ করার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। তার কবিতা বলার ভঙ্গিমা এমনই যা পড়লে মনে হয় এইসময়ের কবিতা এমনই হওয়া উচিত। শুধু তাই নয় প্রতিদিনের জীবনকে সে যেভাবে কবিতায় তুলে আনে তা তার বিশেষ এক দক্ষতার পরিচয় দেয়। আজকের মতো এইভাবে সাম্য যদি এগিয়ে যেতে পারে তাহলে আগামীতে আমরা তাকে এক বিশেষ জায়গায় উন্নীত হতে দেখব। অবশ্যই তার কবিতা বিভিন্ন দিকে বাঁক নেবে এবং আমরা তার এগিয়ে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকব।

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *