সাম্য রাইয়ানের সাক্ষাৎকার : লাবণী মণ্ডল


সাম্য রাইয়ান- কবি, প্রাবন্ধিক, লিটল ম্যাগাজিন কর্মী, অ্যাকটিভিস্ট। সম্প্রতি তিনি কবিতা, কবিতার বিভিন্ন ধরন, লিটল ম্যাগাজিনসহ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির নানাদিক, নিজের কাজ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। সেখানে উঠে আসে কবিতা ভাবনা, জীবন ভাবনা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন নিয়ে স্বকীয় চিন্তার প্রতিফলন। ২০২২-এ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন লাবণী মণ্ডল

লাবণী মণ্ডল: আপনার কবিতার সূচনা ও যাত্রাপথ সম্পর্কে জানতে চাই।
সাম্য রাইয়ান: শব্দখেলার আনন্দ থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম। তখন প্রাইমারী স্কুলে পড়ি। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে অন্তমিল তৈরি করতে, সুর তৈরি করতে আনন্দ হতো। সেই থেকে শুরু, এরপর তো চলছে। ছোটবেলা থেকে গল্পের বই পড়া নেশা হয়ে গিয়েছিলো। পিতৃপ্রজন্মের কল্যাণে আমি জন্মের পরই বাড়িতে বইয়ের সমারোহ পেয়েছিলাম। সেই থেকে বইয়ের সাম্রাজ্যে ঢুকে গেলাম!

লাবণী মণ্ডল: আপনার কাছে কবিতা মানে কী?
সাম্য রাইয়ান: কবিতা আমার কাছে জীবনদর্শন। সূর্যের এক হাত নিচে মেলে দেয়া শরীরের দগদগে ঘা।

লাবণী মণ্ডল: কবিতার বিভিন্ন ধরন বা ফর্ম আছে। আবার এ সময়ে আমরা দেখছি শিল্প-সাহিত্যের অন্যান্য অনেক ধারার মতো কবিতাও ফর্ম থেকে বেরিয়ে আসছে। কবিতার এ দীর্ঘ যাত্রাপথে আধুনিক-উত্তরাধুনিক কবিতার বিভাজন বা ছন্দের ধারা সবই ভেঙে পড়ছে। আবার নতুন ফর্ম গড়েও উঠছে। এ প্রসঙ্গে আপনার মতামত কী?
সাম্য রাইয়ান: কবিতার ফর্ম নিয়তই পরিবর্তন হচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক। ফর্ম মুক্ত হওয়া আসলে একটা ধাঁধা। কারণ তা কেবলই এক ফর্ম থেকে বেরিয়ে আরেক ফর্মের দিকে যাত্রা!

লাবণী মণ্ডল: সার্থক কবিতা হয়ে ওঠার জন্য একটি কবিতায় কী কী থাকা জরুরি মনে হয়?
সাম্য রাইয়ান: সার্থক কবিতা হয়ে ওঠার জন্য অনুকরণ বাদ দিতে হবে। আবার বলি, অনুকরণ বাদ দিতে হবে। অনুকরণ মানুষ করবে না, অনুকরণ বানরের ধর্ম, মানুষ বানর নয়। প্রথমত, চিন্তার গভীরতা থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, সেই চিন্তার প্রকাশভঙ্গি নতুন হতে হবে। আর সবচেয়ে যেটা বড় কথা, চিন্তাটা সৎ হতে হবে।

লাবণী মণ্ডল: সমকালীন ও বিশ্ব সাহিত্যে কাদের লেখা আপনাকে প্রভাবিত করেছে?
সাম্য রাইয়ান: আমার মনে হয়, আমি এ যাবৎ যা কিছু পাঠ করেছি, তার সবই আমাকে কোন না কোনভাবে প্রভাবিত করেছে।

লাবণী মণ্ডল: আপনার কবি সত্তা-প্রাবন্ধিক সত্তা-সম্পাদক সত্তা, এ তিনটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
সাম্য রাইয়ান: আমি মূলত কবিতা লিখি। মাঝেমধ্যে প্রবন্ধ লিখি। পরিমাণে তা খুবই কম। আর সম্পাদনার কথা বললে এভাবে বলতেই পছন্দ করবো—আমি প্রধানত লেখক, লেখার প্রয়োজনে সম্পাদক। নিজের ভেতরে সম্পাদক সত্তা আমার লেখার ক্ষেত্রে খুবই সহায়ক ভূমিকা রাখে। নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে সুবিধে হয়। আমি নিজেই নিজের প্রথম ও প্রধান বিচারক।

লাবণী মণ্ডল: উৎপলকুমার বসু বিগত শতাব্দীর পাঁচের দশকের কবি। তাঁকে নিয়ে আপনার সম্পাদনায় একটি বই প্রকাশিত হয়েছে গত বইমেলায়। তিনি কেন আজও প্রাসঙ্গিক?
সাম্য রাইয়ান: উৎপলকুমার বসু এমনই এক কবি, যিনি বেঁচে থাকতেই হয়ে উঠেছিলেন বাংলা কবিতা জগতের অনিবার্য নাম। তার কবিতা পাঠকের কাছে এক বিস্ময় আর রহস্যের আধার হিসেবে আবির্ভূত হয়। তিনি তো সকলের মতো লেখেন না, তার আছে এক ‘ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা’। যার সম্মুখে দাঁড়ালে মনে হয়, এর সকল শব্দই বুঝি অমোঘ—বিকল্পহীন! পুজো করতে নয়, আতশকাচের তলায় বুঝে নেওয়ার কাঙ্ক্ষা থেকেই ২০১৫ সালে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করি বিন্দুর উৎপলকুমার বসু সংখ্যা প্রকাশের। এর মধ্যে আমাদের হতবিহ্বল করে উৎপল প্রয়াত হলেন ওই বছরের অক্টোবরে। পরের বছর সেপ্টেম্বরে মাত্র ছয়জন লেখকের প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশ করলাম বিন্দুর ক্রোড়পত্র— ‘স্পর্শ করে অন্য নানা ফুল’। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ সংখ্যা প্রকাশের ভাবনা মাথায় রয়েই গেল। অবশেষে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রায় চারশত পৃষ্ঠার সেই বই আলোর মুখ দেখেছে, ভারত ও বাঙলাদেশের অর্ধশতাধিক লেখকের প্রবন্ধ নিয়ে।

লাবণী মণ্ডল: কবিতার অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি অর্থাৎ আঙ্গিক, উপমা, ছন্দ, শব্দের বুনন, ভাষার ব্যবহার, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মিথ ইত্যাদি সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
সাম্য রাইয়ান: কবিতার আঙ্গিক, তার শরীরে ছন্দ—এই সকলই চলে আসে কবিতার প্রয়োজনে। ফর্মটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি এমন কোনো ফর্মে লিখতে চাই না যা চর্বিতচর্বন। নতুন চিন্তা, যা আমি প্রকাশ করি, প্রচার করি; তা নতুন ফর্মেই প্রকাশ করতে পছন্দ করি। এ ক্ষেত্রে অবশ্য জঁ লুক গোদার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সুবিমল মিশ্র লিখেছিলেন, ‘বলার ভঙ্গিটাই যখন বিষয় হয়ে ওঠে।’ কখনো কখনো এমনটাও হয়; আঙ্গিক নিজেই বিষয় হয়ে উঠতে পারে। আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রত্যেক লেখকের মধ্যেই থাকে; যদি তিনি ‘ক্রিয়েটিভ লেখক’ হন। আমার কবিতার ক্ষেত্রে একসময় নিরীক্ষাচেষ্টাগুলো জ্বলজ্বলে হয়ে থাকতো, কারণ সেই নিরীক্ষাগুলো ছিলো বাহ্যিক, দৃশ্যমান। কিন্তু আমার বর্তমান কবিতায় বাহ্যিক, দৃশ্যমান নিরীক্ষা কমে তা কবিতার অন্তরে প্রবেশ করেছে। আমার সকল বইয়েই নতুন কিছু কাজ আমি করতে চেষ্টা করেছি; নতুন শব্দবন্ধ, বাক্যগঠন, চিন্তায় নতুনত্ব...। কিন্তু তা পাঠকের পাঠপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে না। আমি বই প্রকাশের ক্ষেত্রে সংকলন করি না, কনসেপচুয়ালী পাণ্ডুলিপি গোছাই। প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি কথা বলি, ‘লোকাল ট্রেনের জার্নাল’ বইয়ে এমন ধরনের গদ্য আমি লিখেছি, যা আমার জানামতে নতুন। ২০১১ থেকে এই ধরনের গদ্য আমি লিখতে শুরু করেছি। রাঁধুনী কতটা এক্সপেরিমেন্ট করে তরকারি রেঁধেছেন এটা ভোজন রসিকের আগ্রহের বিষয় নয়; তার একমাত্র আগ্রহ স্বাদে। এক্সপেরিমেন্ট বা কৌশল রাঁধুনীর ব্যক্তিগত বিষয়। আর নিরীক্ষা যেন পাঠ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত না করে। ধরুন, একজন ইঞ্জিনিয়ার ভাবল বাসের সিট কভারে এত বছর এত এক্সপেরিমেন্ট করলাম, সবাই তার সুফল ভোগ করল—আরামে ভ্রমণ করলো; কিন্তু এর জন্য কত এক্সপেরিমেন্ট করতে হয়েছে তা নিয়ে যেহেতু কেউ কথা বলছে না, এবার একটা দারুণ এক্সপেরিমেন্ট করা যাক। এই ভেবে তিনি বাসের সিট কভারে কাটা গেঁথে দিলেন। বাসের যাত্রীরা এবার হারে হারে টের পেল ইঞ্জিনিয়ার এক্সপেরিন্ট করেছেন! তো এই ধরনের লোক দেখানো এক্সপেরিমেন্ট আমি করি না। পেন ওয়ারেন তার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “এক্সপেরিমেন্টাল লেখা আবার কী? জেমস জয়েস কোনো এক্সপেরিমেন্টাল লেখা লেখেননি, তিনি ‘ইউলিসিস’ লিখেছেন। টি এস এলিয়ট ‘দি ওয়েস্ট ল্যান্ড’ লিখেছেন। যখন আপনারা একটা জিনিস ঠিক ধরতে পারেন না, তখনই তাকে এক্সপেরিমেন্ট বলে ফেলেন; এটা চাপাবাজির একটা অভিজাত শব্দ।”

লাবণী মণ্ডল: সচেতনভাবে, অবচেতনে বা পরিকল্পনা করে, বিভিন্ন উপায়ে কবিতা লেখার কথা প্রচলিত রয়েছে; এ ব্যাপারে আপনি কী মনে করেন ও নিজে কীভাবে লেখেন?
সাম্য রাইয়ান: কবিতাগুলো আসলে কী এক ঘোরের মধ্যে লেখা হয়ে যায়, লেখাটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘোরটা থাকেই! তাহলে কি একটা ঘোর কেটে গেল মানে একটা কবিতা শেষ হলো? আমার কাছে বিষয়গুলো এমনই মনে হয়। পিকাসোর একটা উক্তি আছে, ‘I don’t search, I find.’ পিকাসোর কথাটা মনে পড়লো। সম্ভবত অনুসন্ধানী মন অবচেতনে সর্বদাই অ্যাকটিভ থাকে, আর টুকে রাখে।

লাবণী মণ্ডল: কাব্যজীবনে আপনার ভেতরে চলমান সংগ্রাম ও সাংসারিক প্রভাব কতটা উপভোগ্য বা যন্ত্রণার?
সাম্য রাইয়ান: এই সময়ে কবির সন্ন্যাস সংসার ত্যাগ করে নয়, সংসারে থেকেই। যিনি কবি, তিনি সমাজ-সংসারের চলমান কার্যক্রমের মধ্যেই কবি। পারিবারিক যন্ত্রণা নয়; বরং একভাবে বলা যায়—পরিবারের প্রভাবেই আমি অল্প বয়সে আউট বই পড়তে শুরু করি। কিছু তো ঝামেলা থাকেই। কিন্তু সেটা অন্যদের তুলনায় আমার অনেক কম। বরং যা কিছু যন্ত্রণার তার কারণ রাষ্ট্র ও সমাজ।

লাবণী মণ্ডল: এ সময়ে আমাদের শিল্প-সাহিত্যের ধারা অনেকটাই নগরকেন্দ্রিক। অথবা বলা যায় ঢাকাকেন্দ্রিক। এখানে ঢাকা কেন্দ্র, আরা পুরো দেশ প্রান্ত। কবি-সাহিত্যিকদের যেন অনেকটা কেন্দ্রে এসে নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে হয়। আপনি কুড়িগ্রামেই থাকেন। সেখানেই সাহিত্যচর্চার মধ্যে আছেন। বলা যায়, গতানুগতিক ধারায় আপনি প্রান্তের কবি। এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন? এটি কি আমাদের সাহিত্যমানের অবনমনকেই তুলে ধরে?
সাম্য রাইয়ান: প্রথম দশকের গোড়ার দিকে ঢাকায় ছিলাম কয়েক বছর। তারপর চলে আসি কুড়িগ্রাম। তারপর থেকে আছি এখানেই। কয়েকবছর ঢাকায় থেকে আমার মনে হয়েছে, ঢাকায় থাকলে আমার অন্য সবই হয়—শুধু লেখাটা ছাড়া। দেখুন, শুধু ঢাকাই তো বাঙলাদেশ নয়, চৌষট্টি হাজার গ্রামই বাঙলাদেশ। কিন্তু শুধু সাহিত্য নয়, সকল সেক্টরেই আমাদের কেন্দ্র হয়ে গেছে ঢাকা। এর ফলে সকল সেক্টরই ক্ষতিগ্রস্ত। বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার। আর সমস্যা বলে যা হয়েছে তা হলো, অনেকরকম ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়েছে কুড়িগ্রামে থাকার জন্য। দূরত্বটা ফ্যাক্ট হয়েছে অনেক সময়। কিন্তু আমি এগুলো নিয়ে বিচলিত নই। কেননা, আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ...

লাবণী মণ্ডল: লিটল ম্যাগাজিন সাধারণত প্রচলিত ব্যবস্থার বিপরীতে এক ধরনের প্রতিবাদ। বর্তমানে আমাদের দেশে লিটল ম্যাগাজিনের চর্চাকে কীভাবে দেখেন?
সাম্য রাইয়ান: প্রথম দশকের (২০১০–২০২০) মধ্যবর্তী সময় থেকে বাঙলাদেশে কাগজে ছাপা লিটল ম্যাগাজিনের সংখ্যা ভয়াবহ রকম কমে এসেছে। যেগুলো দৃশ্যমান, তার অধিকাংশই আসলে সাধারণ সাহিত্য পত্রিকা। এগুলো তেজহীন বৃদ্ধ ঘোড়া। ২০১৮ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় লিটলম্যাগ চত্বরে যখন বিন্দুর স্টল ভেঙে দিল বাংলা একাডেমি, তখন সেখানে উপস্থিত বাকি ১৬০টি লিটল ম্যাগাজিন, যাদের স্টল ছিল তারা কেউ প্রতিবাদও করেনি। তাদের কারো মনেই হয়নি লিটলম্যাগের স্টল ভেঙে দেওয়ার প্রতিবাদ করা দরকার! এই ঘটনা আমাদের জন্য নতুন উপলব্ধি তৈরি করেছে। বাঙলাদেশের লিটল ম্যাগাজিনগুলোর স্বরূপ উন্মোচন করেছে। একসময় এ দেশে লিটলম্যাগের প্রধানতম কাজ ছিল দৈনিক পত্রিকার বিরোধিতা করা। অথচ লেখক কোথায় লিখবেন, না লিখবেন, এইটা সেকেন্ডারি ইস্যু। ফার্স্ট ইস্যু হচ্ছে লেখক কী লিখবেন, কীভাবে লিখবেন, কেন লিখবেন। কিন্তু এখানে হলো উল্টো। কোন কাগজে লিখবেন, এটাই হয়ে গেল প্রধানতম আলোচ্য। ফলে শিল্পকলায় আর শিল্প নাই, রইলো শুধুই কলা। তারই ফলাফল এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। অবিকশিত এই মুভমেন্ট হাজামজাডোবা পুকুরে ডুবে রইল। আরও দেখা গেল, সারাদেশের লিটলম্যাগগুলো—যারা সত্যিকার অর্থে চর্চাটা করেছিল, এখনো করছে; ঢাকাই লিটলম্যাগঅলারা এবং ঢাকার সাথে যুক্ত লিটলম্যাগঅলারা সেগুলোকে ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়ার একটা ঘৃণ্য চক্রান্ত করল দশকের পর দশক। এই চক্রান্তের অনেক নমুনা প্রকাশিত রয়েছে। আসলে এই সেক্টরও ভরে গেছে কালচারাল ক্রিমিনাল দিয়ে। এখানেও আওয়ামী লীগ আর বিএনপির দালালি চলছে সমানতালে। ফলে সাহিত্য নির্বাসিত, লিটলম্যাগ মুভমেন্ট বিপর্যস্ত। অবস্থা নির্মম, দুঃখজনক।

লাবণী মণ্ডল: আপনি ২০০৬ সাল থেকে লিটল ম্যাগাজিন ‘বিন্দু’ সম্পাদনা করছেন। বর্তমানে অনলাইন ও প্রিন্ট সংস্করণে প্রকাশিত হচ্ছে বিন্দু। অনেক লিটলম্যাগ এর মধ্যে শুরু হয়েছে কিন্তু থেমে গেছে, আবার বিন্দু চলছে, এ বিষয়ে কিছু বলুন।
সাম্য রাইয়ান: আমি বিন্দুর সম্পাদক হলেও বিন্দু আমার একার কাগজ নয়, আমাদের কাগজ; এর সাথে অনেকেই যুক্ত। সকলে মিলে আমরা এটি প্রকাশ করি। প্রথমে বিন্দু যে উদ্দেশ্যে প্রকাশ করেছিলাম তা হলো—আমাদের লিখবার কোনো জায়গা ছিল না। একটা জায়গা দরকার। এত বছর পরে এসেও মনে হয়, আজও কি আছে তেমন জায়গা, যেখানে আমরা হাত খুলে লিখতে পারি? বিন্দুর প্রয়োজনীয়তা আজও রয়েছে এজন্যই যে, আমরা আমাদের লেখাগুলো কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা অন্য যে কোনো শক্তির চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেই এখানে প্রকাশ করতে পারি। এখানে বলে রাখি, দিন দিন লেখক ও পাঠক উভয় দিক থেকেই পরিসর বাড়ছে। আর ওয়েবসাইট (bindumag.com) আরও আগেই দরকার ছিলো, নানা সীমাবদ্ধতায় তা করা হয়ে উঠেনি। ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ থেকে অনলাইন সংস্করণ প্রকাশ শুরু হয়েছে। এতে আরও অধিক লেখা প্রকাশের এবং পাঠকের কাছে পৌঁছনোর সুযোগ হয়েছে।

লাবণী মণ্ডল: বাংলাদেশে সাহিত্য নিয়ে রাজনীতি বিষয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাই। বিশেষত লিটলম্যাগ নিয়ে।
সাম্য রাইয়ান: বাংলাদেশের সাহিত্যে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি আমাদের সবুজ ক্ষেত নষ্ট করে ফেলল। এদেশে বেশির ভাগ লিটলম্যাগ মানে বনসাই প্রকল্প। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী লোকজন এখানে সম্পাদনা করে, বুদ্ধিজীবী সাজে, কবিতা লেখে। সেই কবিতা নিয়ে যখন আপনি মন্তব্য করবেন তখনই বুঝতে পারবেন এদের সিন্ডিকেট কত গভীর। এদের হাতে আপনি মারও খেতে পারেন। আর অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, পয়সাঅলা কিংবা সুন্দরী নারীদের তাদের পয়সা কিংবা শরীরের বিনিময়ে কবি-লেখক বানানোরও অনেকগুলো সিন্ডিকেট এই দেশে আছে। এই দেশে সাহিত্য নিয়ে রাজনীতি খুব নোংরা ও সংকীর্ণভাবে হয়। কবি বা লেখক হতে চাইলে এখানে কোনও না কোনও গোষ্ঠীর হাতে নিজেকে সঁপে দিতে হয়! আপনি কত ভাল কবিতা লেখেন এখানে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, আপনি কোন গোষ্ঠীর সাথে আছেন এটাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি অধিকাংশ লিটলম্যাগও এখন আর লেখা দেখে না, লেখকের দালালি করার যোগ্যতা দেখে। ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে, বস্তাপচা কবিতা হোক সমস্যা নাই, কিন্তু গোলামিতে ঊনিশ-বিশ হলেই আপনি বাতিল। আর আছে গলাবাজি। হম্বিতম্বি। এই শব্দদূষণও সাহিত্যের ক্ষতি করছে।

লাবণী মণ্ডল: বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বর্তমান দুরবস্থার পেছনের কারণগুলো কী?
সাম্য রাইয়ান: বাঙলাদেশে আসলে প্রচলিত সংগঠনের যে ফর্ম, সেইটাই ফেইল করেছে। ফলশ্রুতিতে দেখবেন, প্রচলিত সাহিত্য কিংবা সাংস্কৃতিক সংগঠন, যাদের অবস্থা নব্বই দশকেও রমরমা ছিল, আজ তারা স্রেফ জান নিয়ে টিকে আছে। সংগঠনের ফর্মের পরিবর্তন দরকার। যে সম্ভাবনা আমরা দেখেছি গণজাগরণ মঞ্চের প্রথমদিকের সাংগঠনিক ফর্মে কিংবা আরও পরিণত ফর্ম দেখেছি নিরাপদ সড়কের দাবিতে কিশোর বিদ্রোহে। এই ফর্মেরই বিকাশ দরকার। আরেকটা বিষয় হলো—বর্তমান সংস্কৃতির সাথে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের চলন-বিচলনের বিস্তর ফারাক। আমাদের দেশে একটা কালচারাল রেনেসাঁ দরকার। কিন্তু সংস্কৃতির ভাঙা সেতুর উপর দাঁড়িয়ে তা সম্ভব নয়; এর জন্য সংস্কৃতির নয়া সেতু গড়তে হবে। নেই অন্য কোনো সহজ বিকল্প।

লাবণী মণ্ডল: লেখালিখির সাথে আপনি একজন অ্যাকটিভিস্টও বটে, এই দুটো পাশাপাশি চলতে অসুবিধে হয় না?
সাম্য রাইয়ান: বর্তমান সময়ে ক্যাপিটালিজমের বহুমুখী আগ্রাসনের মুখে দাঁড়িয়ে একজন মেরুদণ্ডসম্পন্ন লেখককে শুধু নিজের লেখাটি লিখলেই চলে না। সেই লেখা প্রকাশে অ্যাকটিভিস্টের ভূমিকায়ও নামতে হয়। সময় বদলেছে। বদলাচ্ছে। আরও বদলাবে। আক্রমণের রূপ বদলাচ্ছে। আপনাকে শুধু ভাত-কাপড়ে মারবে না এখন। আরও নানান কৌশলে মারবে। আপনি হাঁটা-চলা করবেন, লম্ফঝম্ফ করবেন, কিন্তু বেঁচে থাকবেন না। প্রতিষ্ঠান-পাওয়ার এর পক্ষের লোকজন নানা রূপে আপনাকে ভেতর থেকে মেরে ফেলবে। আপনাকে অস্থির-অশান্ত করে তুলবে, জীবন অসহ্য করে তুলবে। এমনকি তারা লিটলম্যাগের বেশে হাজির হয়েও এটা করবে। এমন অবস্থায় চুপচাপ বসে থাকা মানে মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া। যা করতে হবে তা হলো—নিজের লেখাটা লিখে যেতে হবে, তা প্রকাশ করার জন্য লিটলম্যাগ জারি রাখতে হবে। লেখাটাই আসল কথা। এটাই সব ষড়যন্ত্রের মোক্ষম জবাব। লেখকের ব্রহ্মাস্ত্র। এটাই লেখকের প্রধানতম অ্যাকটিভিজম। লেখকজীবনের প্রধান কথা।

লাবণী মণ্ডল: জীবন নিয়ে আপনার ভাবনা...
সাম্য রাইয়ান: কবিকে আমার কেবলই মনে হয়—জীবনব্যাপী সম্পর্কশাস্ত্র বিষয়ে গবেষণা করে চলা ব্যক্তি। সে নানান সম্পর্ক—প্রাণের সাথে প্রাণের, প্রাণের সাথে প্রাণহীনের, ক্ষুদ্রপ্রাণের সাথে মহাপ্রাণের—সকল সম্পর্ক। এই প্রকারের সম্পর্ক স্থাপন-রক্ষা-চ্ছেদ-বিকাশ বিষয়েই মনে হয় জীবনের সকল গবেষণা। সেই সম্পর্কশাস্ত্রেরই আরেক নাম প্রেম। যা বেঁচে থাকার আনন্দ-বেদনা এবং অনুপ্রেরণা। তাই তো চোখের ভেতরে একটা হামিংবার্ড নিয়ে বসে আছি...

[মনমানচিত্র (আমেরিকা) পত্রিকার সাম্য রাইয়ান বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত৷]

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *