সাম্য রাইয়ানের সাক্ষাৎকার : গল্প পত্রিকা বয়ান


বাঙলাদেশের অন্যতম গল্প পত্রিকা ‘বয়ান’-এর চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যায় (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৮) ছাপা হয় সাম্য রাইয়ানের এই সাক্ষাৎকারটি। যা বয়ান সম্পাদক অমিতা চক্রবর্তী কর্তৃক গৃহীত। ছাপা ফর্মেটে প্রশ্নগুলোকে সরিয়ে শুধু সাম্য রাইয়ানের উত্তরগুলোকে রাখা হয়েছিল। তাই এখানেও সেভাবেই প্রকাশ করা হল।

সময়ের নিবিড় চিত্র লেখার জন্য লেখকের দরকার পাণ্ডিত্য, নিবিড় পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। কিন্তু বর্তমান সময়ে লেখকদের মধ্যে এই দুই বস্তুর পরিমাণই অপ্রতুল। এত অপ্রতুল যোগ্যতা নিয়ে সৈয়দ শামসুল হকের মতো দলদাস হওয়া যায় (যা তিনি জীবনের শেষ পর্বে হয়েছিলেন) কিন্তু সৈয়দ শামসুল হকের মতো এক পিস ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ লেখা যায় না। এখন সবাই আছে টাকা আর ক্ষমতার ধান্দায়। ক্ষমতাসীনদের ‘ব্ল্যাক পাওয়ার’ এর ভাগের আশায়। এই ধরনের লেখকদের কাছে উঁচুমানের সাহিত্য আশা করা বোকামি। এইসবের বাইরে যারা আছেন, তারাও লেখালিখিতে খুব বেশি ‘সুবিধে’ করতে পারছেন না নানাবিধ সীমাবদ্ধতার কারণে। তবে পরিস্থিতি বদলাবে। সময় লাগছে। যেহেতু রাষ্ট্রের বিকাশের সাথেই দেশের শিল্প–সংস্কৃতির বিকাশ যুক্ত। এই দেশটার মায়াবী–করুণ মুখখানার দিকে তাকালেই আমার মায়া হয়। ভাবি, এই দেশে, কিছু লোক লোভ–খ্যাতির মোহমুক্ত হয়েও যে লিখছে, এইই তো বেশি।

প্রভাবশালী গল্প লেখা হলে তবেই না সমাজে গল্পের প্রভাব পড়বে। লেখাই তো হচ্ছে না ওরকম গল্প। অথবা লেখা হলেও হয়তো প্রকাশিত হয় না। এইসব, শিল্প–সাহিত্যের ভোক্তা যেহেতু শিক্ষিত–মধ্যবিত্ত শ্রেণি, ফলে তাদেরকে আলোড়িত করবার মতো, তাদের মধ্যে প্রভাব রাখবার মতো গল্প লেখা হলে অবশ্যই তা দৃশ্যমান হতো। এই সংকট শুধু গল্পে না; সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও রয়েছে। হুমায়ুন আজাদ, শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, তার আগে তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমূখ লেখকগণ যতোটা সাহস–পান্ডিত্য নিয়ে গল্প–উপন্যাস রচনা করেছেন, সেই সাহস–পাণ্ডিত্য, সততা আজকাল আমরা দেখি না। শুধু দেখি কসরৎ; এক মিনিটের জন্য বিখ্যাত হবার।

সমাজের সেই স্তরের নাম ‘লেখক’, যে স্তর গোটা সমাজকে পথ দেখায়। অথচ আজ লেখকই পথ হারিয়ে কলুষিত রাজনীতিবিদের কোলের কুত্তা হয়ে পায়ের কাছে বসে আছে! কতজন লেখক বাঙলাদেশের রাজনীতি সচেতন? যে ব্যবস্থায় রাজনীতিই সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে লেখকগণ নির্লজ্জভাবে প্রচলিত রাজনীতির কাছেই নিজে সঁপে দিয়েছেন। তাহলে সমাজকে পথ দেখাবে কে? এই সমাজে যত ব্যক্তি ‘লেখক’ হিসেবে হাজির রয়েছেন, প্রকৃতপ্রস্তাবে তার আশি শতাংশই দলিললেখক। শেক্সপীয়রের সেই ‘রঙ্গমঞ্চে’ ‘লেখক’ চরিত্রে অভিনয় করে চলেছেন মাত্র।

প্রবীণদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র ‘লেখক’ রয়েছেন। তাদেরকে সালাম। আর তরুণ যে জেনারেশনটি সদ্য লেখার বাজারে হাজির হয়েছে তারা অনেকগুলো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাবে। যার কারণে কোয়ালিটি এবং কোয়ানটিটির দিক থেকে ‘লেখক’ এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা আছে বলে আমি মনে করি। আর প্রযুক্তি–প্লাবনের কারণে আগামীদিনে বড় ধরনের পাঠকশূন্যতায় ভুগতে হবে। কারণ সাধারণ পাঠকের সংখ্যা যেমন কমেছে, তেমনই কমেছে লেখকপাঠকের সংখ্যাও। যার কারণে শুধু লেখকই না বরং খুব বড় হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে এই সোসাইটি। তারপর, আবারও, যথারীতি বইয়ের কাছে, শিল্পের কাছে ফিরে আসবে পরিত্রাণের আশায়। ফিরতে তাকে হবেই।

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *