❑ আইরিন সুলতানা
“যে পথে স্পিডব্রেকার নেই সেটা তো নিরামিষ পথ” —পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে পাঠক ঠিক এখানে থেমে যাবেন। সাম্য রাইয়ানকে যদি আগে পড়া না থাকে, তবে ‘লিখিত রাত্রি’ দিয়ে সে যাত্রা শুরু হবে রাতের ট্রেন যাত্রার মত গাঢ়। ‘লিখিত রাত্রি’ ছিমছাম একটি কাব্যগ্রন্থ। প্রতি পাতার মাঝে এক স্তবক পঞ্চ পংক্তি, যার আলাদা কোনো শিরোনাম নেই; নম্বর ধরে ধরে এভাবে পঞ্চান্নটি কবিতা। হুট করে মনে পড়ল, ‘পঞ্চানুপ্রাস’ কাঠামোর কবিতা নিয়ে আগে কোথাও কিছু চোখে পড়েছিল। লিখিত রাত্রির কবিতাগুলো প্রায় ওই কাঠামো ছুঁয়ে এগিয়েছে। তবে পঞ্চানুপ্রাসে একেকটি পংক্তি পঞ্চদশ মাত্রার হতে হয় নাকি! ‘লিখিত রাত্রি’র পঞ্চ পংক্তির কোনোটি সতের, কোনোটি আঠার কি উনিশ মাত্রার। পাঠকের জন্য অবশ্য মাত্রা গুনে পড়ার কোনোই বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ পাঠক তো রাতের ট্রেন যাত্রার আবেশে রয়েছে।
মানুষের মনে হুট করে কত খেয়াল ধরা দেয়! সেই খেয়াল স্থির হয়ে বসে, অথবা এসেই চলে যায়। সেই খেয়ালের কাব্য ‘লিখিত রাত্রি’।
“এই যে প্রতিদিন কতবার দিনে-দুপুরে খুন
হয়ে যাচ্ছি; কেউ টের পাচ্ছে না, কিছু বলছে না”
উনিশ নম্বর কবিতার এই লাইন পাঠকের মরমে গেঁথে যাবে। এই পংক্তি একবার মনে হবে এতো বাইরের ছোঁয়া পেতে আর্তনাদ; তারপর মনে হবে এদিকে মন বাইরের প্রতি উন্নাসিক বলে তো বাইরের কেউ টের পায় না কী করে ক্ষয়ে যাচ্ছে সব।
উন্নাসিকতা বেড়ে যাবে আরো এক ধাপ, পঁয়তাল্লিশ নম্বর কবিতায়—
“পেছনে একটা লাত্থি আমি দিতেই পারি কষে
আজকাল কে খোঁজ নেবে, আর করবে প্রতিবাদ?”
কতটা যোগাযোগহীন হয়ে গেলে মানুষের খোঁজ নেয়না আরেক মানুষ? তখন একা হওয়া মানুষটি এভাবে ছিন্নভিন্ন করতে চায় সবকিছু। ক্ষোভের উদগীরণে, অথবা কেউ যদি আসে ভেবে এমন ধ্বংস রচনা করে মানুষটি।
তেইশ নম্বরে “মাথাব্যথাহীন সময়গুলো খুব উপভোগ্য মনে হয়” এবং চব্বিশ নম্বরে “জীবন, তুমি তার আঙ্গুলের সমানও নও” পড়তে গিয়ে এই লাইনগুলো কয়েকবার করে আওড়াতে ভালো লাগবে পাঠকের।
ঊনপঞ্চাশ নম্বর কবিতায় আছে—
“যেতে যেতে পথে, মধ্যরাতে; কুকুর, পুলিশ ও
বেশ্যাকে নিঃশব্দে বলি– পথ আটকানো নিষেধ।”
দুটো লাইন পড়তে পড়তে দৃশ্যটা পাঠক চোখে কল্পনা করবেনই। তাতে পাঠক নিজেকে নিশুতি রাতে পাবেন, যে রাতে আরো তিনটি চরিত্র হানা দেয়- কুকুর, পুলিশ ও বেশ্যা। এদের পেরিয়ে পাঠক চলে যাবেন প্রেমিক, কবি ও পাগলের কাছে।
তেপ্পান্ন নম্বরে ‘বাবার কান থেকে খসে যাচ্ছে গ্রামোফোনের সুর...’ যেন প্রাচীনকে ফেলে আসার কথা বললেন কবি। যেন বনেদি নন্দনতত্ত্ব থেকে সরে যাচ্ছি আমরা। পরের লাইনে অবশ্য প্রেমের আবেদন আছে। আর সেই প্রেম নেমে আসে তখন যখন আশেপাশে ছকের বাইরে কোনো ঘটনা ঘটছে।
‘লিখিত রাত্রি’ উচ্চকণ্ঠে রেওয়াজের কাব্যগ্রন্থ নয়; আবার শোনা যায় না এমনও নয়। ভাবনার পর্বত ও গিরিখাত কবিতায় এগিয়েছে মধ্য সপ্তকে। পাঠকের মনে-মগজের অলিগলিতে প্রতি স্তবক পঞ্চ পংক্তি ভারী আওয়াজ তুলবে, তবুও রাতের নিরবতা খান খান হবে না।
সাম্য রাইয়ানের এই কাব্যগ্রন্থটির রচনাকাল ২০১৫ সাল, তবে ছাপা হয়েছে ২০২২ সালে। একেক স্তবকে পঞ্চ পংক্তি নিয়ে এই কাব্যগ্রন্থ কবিতায় নিরীক্ষা খোঁজা লেখক-পাঠকের ভালো লাগবে।
’সুবিমল মিশ্র প্রসঙ্গে কতিপয় নোট’ নামে সাম্য রাইয়ানের আরেকটি গ্রন্থ রয়েছে। এই গ্রন্থ কখনও সাক্ষাৎকার, কখনও প্রবন্ধ। বলতে গেলে কড়কড়ে একটি রচনা লিখেছেন সাম্য রাইয়ান; ক্ষণে ক্ষণে ঝাঁঝও মেশানো রয়েছে। লেখক নিজে এই রচনাকে ’নোট’ বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন, তবে এটিকে সুবিমল মিশ্রকে নিয়ে ক্ষুদে গবেষণা ও সুবিমল মিশ্রের প্রতি মোহের প্রকাশও বলা যায়। হালকা ওজনের এই রচনা পড়তে শুরু করলে দ্রুত শেষ হবে। কিন্তু এই রচনা বুঝতে হলে সুবিমল মিশ্র ও সাম্য রাইয়ান দুজনকেই পাঠ করতে হবে পাঠকের।