‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’

❑ আদিবা নুসরাত

সাম্য রাইয়ান এর লেখা সেটা হোক গল্প কিংবা কবিতা আমাকে প্রথমত যে বিষয়টা মুগ্ধ করে সেটা উনার নামকরণ। তারপর আরো অন্যান্য যেইসব বিষয়াবলি রয়েছে বলব সবকিছুই ধীরে, যেহেতু আলোচনা টা সম্পূর্ণই উনার উপর। সাম্য রাইয়ান উত্তর আধুনিক পিরিয়ডের কবি। উনার কবিতায় বারবার সেই ছাপ উঠে এসেছে৷ তিনি ডিল করেন আধুনিক মানুষের সমস্যা, এবং তাদের মনস্তত্ত্বকে সেইসাথে তার লেখায় অবধারিতভাবে মিশে থাকে উনার নিজস্ব জীবন দর্শন। তবে কিছু কিছু জায়গায় তাকে রিড করা যায় না, নিজকে নৈর্ব্যাক্তিক রাখার এই ব্যপারটা মানে এই নেগেটিভ ক্যাপাবিলিটি সহজ জিনিস নয়। এটা আয়ত্ত্ব করতে যে পরিমাণ মুন্সীয়ানা প্রয়োজন সাম্য রাইয়ান এর সেটা সুষমভাবে রয়েছে৷ 

আমি প্রথমত লিখতে চাই সাম্য রাইয়ান এর কবিতা নিয়ে৷ কবিতায় গদ্যের মতো অসংখ্য চরিত্র নেই বলেই হয়তো কবিতা নিয়ে কাটাছেঁড়া করা খানিক দুর্বোধ্য, জটিল এবং বিস্তৃত। সাম্য রাইয়ান এর কবিতা ‘নিউটন’ থেকে—

“নিরাকার— জলের সাইরেন৷
এলো আমফান— সাফোর 
কলোনীতে৷ বৃষ্টিবৈভবে জেগে উঠি৷
শব্দ হয়৷”

শুরুর এই কয়েক লাইনে কবি চিত্রিত করেছেন এক অসাধারণ ইমেজ। যেন দেখতে পাই জল, আকারহীন এক তরল। সেই জল সাইরেন বাজিয়ে আসছে কারণ ঝড় উঠেছে, আমফান। ভাষার এই যে জ্যামেটিক প্যাটার্ন এইখানে এসে হৃদয় বুঁদ হয়ে যায়। এইখানে আমি দেখতে পাই প্রবল দমকা হাওয়ায় পাতা উড়ছে এদিক সেদিক। সমস্ত শব্দসীমা জুড়ে কেবল মেঘের গর্জন। এই বৃষ্টিবৈভবে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত চেতনা নাকি জল একাকার করে দিচ্ছে সব স্মৃতির দ্বার সেটা সঠিকভাবে জানেন কেবল কবি। 
তবে কবি লিখেছেন ‘শব্দ হয়...!’
বৃষ্টির ঝুপঝাপ শব্দের সাথে এইখানে যেন গভীরভাবে টের পাওয়া যায় কবির মেলানকোলিয়া। শব্দ হয়, যেন সাইসাই করে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন। মেলট্রেন তাই থামার কোন অবসর নাই। ভেসে যাচ্ছে সাফোর কলোনী, ভেসে যাচ্ছে সে নিজেও!
মনে পড়ে কালিদাস, মনে পড়ে মেঘদূত, মনে পড়ে অলকানগরী। 

“নিউটন, আপেলতলায় থাকো৷
বাড়িতে যেও না৷”

এইখানে কবি যাকে সম্বোধন করেছেন তিনি স্বয়ং নিউটন৷ এইখানে কবি ইন্ডিকেট করেছে নিউটন এবং তার আপেলতত্ত্বের ইতিহাস। কেন এইখানে নিউটন এলো সেই বিশ্লেষণে পরে যাচ্ছি। এইখানে কবির এই ইল্যুশনের ব্যবহার কবিতাকে নিয়ে গেছে আরেক মাত্রায়। নিউটন কেন আপেলতলায় থাকবে তার উত্তর পাবো আমরা পরবর্তী দুই লাইনে। আপাতত নিউটনের আপেল তলায় থাকার যে আদেশ অথবা অনুনয় যেটাই বলি না কেন সেটা নিয়ে কিঞ্চিৎ কাটাছেঁড়া করি৷ এই দুটো লাইন পড়তে গিয়ে আমার বারবার মনে পড়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে, “আধেকলীন হৃদয় দূরগামী/ ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি /কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া / অবনী বাড়ি আছো?”

অবনীকে করা এই প্রশ্ন আসলে প্রশ্ন নয়, সংশয়। দূরগামী হৃদয় ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে ঘুমে। তবুও ভালো জেগে উঠাতো আরো বেশি কষ্টের। অবনী যদি এইখানে কবির আত্মসাক্ষাৎকারের আয়না হয় তবে ‘নিউটন’ও তাই। এই লাইনে এসে কবি সাম্য রাইয়ানের জীবনদর্শন সম্পর্কেও একটা পাঠ আমরা পাই ভীষণ সূক্ষভাবে। 

“বাড়িতে হৃদয় নেই৷
মানুষভর্তি বেদনা৷”

এই লাইন পড়ার পর আমি টের পাই আমার কল্পনায় কে যেন তুলে দিচ্ছে এক ঘর, চিনামাটির বাসন কোসন, বাড়ির মতো ঘ্রাণ, প্রতিটি আলাদা কক্ষে পরম স্বজনেরা। বাড়ির উঠান পার হলেই নদী, ঠান্ডা মিহি জল। তার ঠিক উল্টোদিকে দুটো আপেল গাছ।

সেইখানে হয়তো শীত আসি আসি দিন। গাছ থেকে উড়ে যাচ্ছে জীর্ণ পাতারা মর্মর শব্দে৷ এদিকে টেবিলে কেটে রাখা অর্ধেক নাশপাতি- হৃদয়াকৃতির৷ সব রস যার শুষে নিয়েছে সময়- শরীরজুড়ে বাদামী ছোপ৷ 

উঠানে যে বসে আছে তার ঘর ভেঙে গেছে, মেয়ের অসুখ। যে শুয়ে আছে গালিচায় তার স্বামী তাকে ছেড়ে গেছে। যে লোক নতুন এসেছে ঘর খোঁজার দায়ে, তার নাম লেওপোল্ড ব্লুম সে এসেছে সূদুর ডাবলিন শহর ছেড়ে। তার হৃদয়ে কিসের ক্ষত আপনারা জানেন সবাই৷

এই লাইনে কবি সাম্য রাইয়ান দেখিয়েছেন মডার্ণ পিপলদের অসহায়ত্ব তাদের এক্সট্রিম বেদনা। যে বেদনা হৃদয় ভেদ করে আশ্রয় নিয়েছে সমগ্র শরীরে কারণ হৃদয় পর্যাপ্ত নয়। দুঃখ বহনের এই ভিন্ন প্রয়াসে আমরা সম্ভবত ক্লান্ত ভীষণ তার চেয়ে ভাল থেকে যাই এই আপেলতলায়। এই লাইনে যখন হৃদয় অবশ সম্পূর্ণ তখন মাথায় বাজছে ম্যাথু আর্নল্ড - 

“Hath really neither joy,
nor love, nor light, 

nor certitude, nor peace,
nor help for pain.”

কবি সাম্য রাইয়ানের কবিতার এই শেষাংশের ধারণা প্রকৃত অর্থে ব্যাপক, বিস্তৃত৷ এইখানে মোটাদাগে কবিকে মনে হবে এস্কেপিস্ট। মনে হবে যেন তিনি মুখোমুখি হতে চাচ্ছেন না রিয়েলিজমের। আদতে বিষয়টা সেরকম নয়। লাইনগুলো পারতপক্ষে নায়ালিস্টিক মনে হলেও এইখানে কবি চিহ্নিত করেছেন আধুনিক মানুষের ইউনিভার্সাল সমস্যা। কবি সবকিছু উপেক্ষা করে সম্মুখীন হয়েছে নিজের মুখোমুখি অনেকটা নিজের সাথে সওয়াল জবাব করার মতো। যেইখানে কোন পলায়নপ্রবৃত্তি থাকে না। এইখানে যেটা থাকে– নিজেকে চিনে ফেলা!  

‘নিউটন’ কবিতায় আমরা আলোচনা করেছি এক ভাববাদী কবিকে নিয়ে। তার চিন্তার খানিক অংশ আরকি। এই ভাববাদী কবি যখন আবার বস্তুবাদ নিয়ে ডিল করতেছে প্যারালালি সেটা প্রেইসওর্থি অবশ্যই। সাম্য রাইয়ান এর যে লেখাটা নিয়ে এখন আলাপ করতে চাই সেটার উনার এক নাতিদীর্ঘ ছোটগল্প, নাম ‘বাঘ’:

“আমার মেয়েটি কিছুদিন থেকে বাঘের মাংস খেতে চায়৷ বাঘ বাঘ করে স্বপ্নে চিৎকার করে আমায় জড়িয়ে ধরে বলে, বাঘ— আমি বাঘের মাংস খাবো৷

বাঘ খুঁজতে বাজারে গিয়েছিলাম৷ পেলাম না৷ মেয়ে বললো, বাবা চলো জঙ্গলে যাই; জঙ্গলে অনেক বাঘ আছে৷

বউকে সাথে নিয়ে জঙ্গলে হাজির হলাম বাঘ খুঁজতে৷ অপেক্ষায় থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে হঠাৎ দূরে বাঘের গর্জন শুনতে পেলাম৷ সতর্ক আমি, ধীরে— ট্রিগার চেপে দিলাম গুলি বেরিয়ে লাগলো বাঘের পেটে৷ শব্দ হলো অনেক৷ কোত্থেকে যেন অতর্কিত চিৎকার এলো, ফায়ার—, একটা গুলি আমার কানের পাশ দিয়ে গেল৷ আমিও গুলি ছুঁড়লাম৷ গোলাগুলি হলো বেশ৷ দেখি— বউটা আমার পড়ে আছে, পাশে মেয়েটাও৷ চিৎকার করে ডাকলাম, বউ ওঠো—, ওঠো বাঘের বাচ্চা, কেউ উঠলো না৷ কারও ঘুম ভাঙলো না৷ শুধু পুলিশ এলো৷

আমাকে আদালতে তোলা হলো৷ বাঘ মেরেছি বলে ১২ বছরের কারাদণ্ড হলো আমার৷ শাস্তির ভারে নূয়ে পড়ে বললাম, আমার স্ত্রী–কন্যা — তাদের মৃত্যুর শাস্তি কেউ পাবে না? আদালত বললেন, অবশ্যই আমরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে৷”

বেসিক্যালি এই গল্পটার আয়তন অনেক ছোট হলেও এর টেক্সট মারাত্মক স্ট্রং। এইখানে লেখক একইসাথে ডিল করতেছে সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক, ব্যাক্তিগত সব সমস্যা একত্রে৷ গল্পের চরিত্রগুলার কোনো নাম নাই৷ মেয়ে তার বাবার কাছে বাঘের মাংস খেতে চায়৷ আর সবকিছু রেখে বাঘের মাংস! এই গল্পের বাঘ এবং বাঘের মাংস সমস্তটাই রূপক। বাঘের মাংস মানে দুর্লভ বস্তু চরম আধুনিক রাষ্ট্র আমাদের শোষণ করতে করতে এই সীমানায় এনে দাড় করায়ছে যে এইখানে সাধারণ চাহিদাগুলোয় যেন বাঘের মাংস! যেগুলো পূরণ করতে গিয়ে কখনো কখনো নিজের জীবনকে রাখতে হচ্ছে বাজি। জীবনের বেসিক নিডগুলাই এত দুর্লভ এইখানে। এবং আরো যে ব্যপারটা, গল্পের শেষে যেটা দেখতে পাই আমরা, যে নিয়মনকানুনগুলো ক্রিয়েট হয়েছিল সাধারণ মানুষের সুবিধার জন্য সেগুলো দিয়েই তাদের কি মোক্ষমভাবে ঘায়েল করা হচ্ছে! যাইহোক আদালত তো সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে৷ গল্পের শেষের এই আইরনি দারুণভাবে মুগ্ধ করে পাঠকদের।

তারারা পত্রিকার সাম্য রাইয়ান বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত৷

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *