প্রেমার্ত কিন্তু প্রেমের কবিতা নয়!

❑ সাম্য রাইয়ান

আজকের কবিতা কি শুধুই দেখতে দেখতে যাওয়া, অহেতু ন্যারেটিভ, তার সাথে খানিকটা বিস্ময়বোধ, না কি শতবর্ষ ধরে চলমান সেই চিরচেনা প্রেমার্তি— বাঙলার দৃষ্টিকর্ণহীন লেখককূল যা মাথায়-কাঁধে বহন করে চলেছে পরম ভক্তিভরে! সেই শব দ্বারা এ বিপুল-জটিল পৃথিবীর সাথে সংযোগ স্থাপন করা যেতে পারে কি? মাধ্যাকর্ষণের বিস্ময়রেখা পেরিয়ে সংযোগ ঘটতে পারে ভেনাসের সাথে? যেমনটা জয় গোস্বামী মনে করতেন, “আমাদের এই পৃথিবীর অনেক ওপর আকাশে ভেসে থাকে ওজোনোস্ফিয়ার। তাকে তো আমরা চোখে দেখতে পাই না। সূর্যের থেকে আসা ক্ষতিকর রশ্মি যে নিঃশব্দে শোষণ করে চলে। পরিশুদ্ধ করে দেয় আমাদের প্রতিদিনের আলো। কোনও কোনও গান, কোনও কোনও কাব্য, চিত্রকলা এইভাবে আমাদের সভ্যতার মন পরিশুদ্ধ করে চলে। ক্ষত উপশম করে। দূর থেকে করে বলেই আমরা বুঝতে পারি না।” সেই ধরনের কবিতা কিংবা চিত্রকলা কিংবা সুরই সভ্যতার আরাধ্য। লাখ লাখ পৃষ্ঠা আবর্জনা লিখে যেমন পরিবেশ বিপর্যয় ব্যতীত কোনো লাভ হয় না, তেমনি কখনো কখনো একটি পংক্তিও প্রাণ-প্রকৃতির উপশমে ভূমিকা রাখতে পারে।

সময়ের বাস্তবতা লেখকের কল্পনার অধিক জটিল, সেই বাস্তবতার রূপায়ন ততোধিক জটিল। সেই জটিল সময়ের অনন্য রূপকার রাশেদুন্নবী সবুজ। সময়ের চিত্র তিনি রচনা করেন রূপক, প্রতীক, উপমার কালিতে। তাঁর কবিতা নতুন চিন্তাকল্পের সূত্রমুখ নিয়ে উপস্থিত হয়। নতুন ডাইমেনশন, বিকল্প আলোকায়নের সন্ধান হাজির করেন অনায়াস সাবলীল ভঙ্গিতে। প্রেমের কবিতা অতি প্রাচীন ও বহুচর্চিত বিষয়। ‘প্রেমের কবিতা’ নামেই প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা ও কবিতাবই। কিন্তু এমন নাম কি চোখে পড়ে, যেমনটা কবি রাশেদুন্নবী সবুজ লিখেছেন, “এটি একটি প্রেমের কবিতা হতে পারতো”! নামের নতুন ব্যঞ্জনা বুঝিয়ে দেয়, এটি প্রেমের কবিতা হয়ে উঠেও শেষমেশ হয়নি; যেন ঠিক না হয়ে ওঠা প্রেমের মতো, কিংবা পূর্ণতা না পাওয়া প্রেমের মতো। কবিতাটি শুরু হচ্ছে ‘টাইটানিক’ রূপকের আশ্চর্য ব্যবহারের মধ্য দিয়ে,
টাইটানিক প্রত্যয় ছিলো আমার উপর তোমার।

শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও টাইটানিক এখনো অনেকের কাছে স্বপ্নের জলযান। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারও স্মৃতি, প্রশ্ন, কৌতুহল আর স্বপ্নভঙ্গের গল্প। প্রত্যাশার ব্যাপকতা- শক্তিমত্তা বোঝাতে মাত্র একটি বাক্যে কবি টাইটানিককে হাজির করে দ্বিতীয় বাক্যেই লিখছেন স্বপ্নভঙ্গের কথা, যার ব্যাপকতা টুইন টাওয়ারের সমান!

সত্যের সামনে দাঁড় করাতেই তুমি ভেঙে পড়লে টুইন টাওয়ারের মতো

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার ভবন বিদ্ধস্ত করার ঘটনাকে শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা বিশ্ব চমকে গিয়েছিল ঘটনার ভয়াবহতায়। টাইটানিকের মতো বিশালতা যে প্রত্যাশার তা ভঙ্গ হলে যে ধ্বংসস্তুপ তৈরি হয় তা টুইন টাওয়ার ছাড়া অন্য কিছুর সাথে তুলনীয় হতে পারে কি? অন্য কোনো উপমা দ্বারা এ অনুভূতি প্রকাশ সম্ভব?

এরপর স্মৃতির বিবরণ দু’বাক্যে, যার অন্তর্নিহিত বাস্তবতা ব্যাপক-বিস্তৃত। কবি লিখছেন,
মিগ টোয়েন্টি নাইনে মন ছুটতো তোমার পাড়ায়, ভেঙে দিলে পাড়াটা বেবিলনের শূন্যদ্যানের মতো।

সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি মিগ টোয়েন্টি নাইনের বৈশিষ্ট্যের দিকে নজর দিলেই পাঠক বুঝতে পারবেন এই রূপকের মধ্য দিয়ে কবি মনের ছুটে চলাকে কতখানি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তুলেছেন। এরপরেই ছুটে বেড়ানো সেই পাড়া, যা ভেঙে পড়ে বেবিলনের শূন্যদ্যানের মতো। যে উদ্যান ৫১৪ খ্রিষ্টাব্দে পারস্য রাজ্যের সাথে এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়েছিল।

এর পরই কবি লিখছেন সকল চোখ এড়িয়ে সংঘটিত সেই চুমুর কথা,
কৃত্রিম উপগ্রহে ধরা পড়েনি আমাকে দেয়া তোমার প্রথম চুমু

কৃত্রিম উপগ্রহ কীভাবে ছায়াপথ থেকে পৃথিবীর অব্যাহত পর্যবেক্ষণ করে চলেছে সে বিষয়ে আমরা জানি। সেই পর্যবেক্ষণও এড়িয়ে গেছে সেই চুমুটি, যা ছিলো প্রথম প্রেমের চিহ্ন-সলজ্জ, আড়ষ্ট, আড়ালপ্রিয়।

সেই প্রেম পরিণত হয় বিচ্ছেদে। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের সূচনা করেন এভাবে,
তোমার ভালোবাসা পাওয়া পাঞ্জাবিটা ব্রিটিশ মিউজিয়ামে স্থান করে নিয়েছে।

থাকে শুধু স্মৃতি- প্রেমে, অপ্রেমে! প্রেম না থাকলেও সেই স্মৃতি ফেলনা নয়, নয় পরিত্যাক্ত-তাই তার জায়গা হয় পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ব্রিটিশ মিউজিয়ামে, যাতে তা দর্শনের সুযোগ ঘটে অন্যদের! ভাবনায় বৈচিত্র্য দেখে অবাক না হয়ে উপায় নাই। কবি চাইছেন, সেই স্মৃতিসমেত মানুষটিকে লোকে জানুক রোমিও-জুলিয়েট, লাইলি-মজনু কিংবা ‘খুনি শাহজাহানের’ মতো করে। শেষ উপমায় কবি প্রচলিত ইতিহাসের কাউন্টার দিয়েছেন। যে সম্রাট পরিচিত প্রেমের নিদর্শন ‘তাজমহল’ নির্মাণের জন্য, তাকে কবি খুনি হিসেবে চিহ্নিত করছেন। কেননা সম্রাটের রয়েছে প্রেমহত্যার অগণিত আড়ালে থাকা ইতিহাস। আগের দিনের রাজা-বাদশাহরা গৃহপালিত লেখক কবি পুষতেন। তাদের কাজ ছিল রাজাদের গুণকীর্তন প্রচার করা। তারাই রাজা-বাদশাহদের গুণকীর্তন লিখতো, প্রচার করতো। ইবনে খালদুন বলেছিলেন, “একটি জাতির সঠিক ইতিহাস ঘটনার ১০০ বছর পরে সঠিকভাবে রচিত হয়।” এখানেও তা প্রযোজ্য। দীর্ঘকাল পর সম্রাট শাহজাহানের সেই চাপা পড়া রূপ বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে, আর তারই উপস্থাপন ঘটেছে এই কবিতায়। কবি কি চাইছেন, শতবর্ষ পরে ‘প্রেমিক শাহজাহান’-এর ‘খুনি’ রূপ যেভাবে সামনে এসেছে সেভাবেই স্মৃতিজড়ানো পাঞ্জাবীর গল্পটি লোকে জানুক?

কবিতার শেষ পংক্তিটি যেন মনে করিয়ে দেয় রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর আকাশের ঠিকানার কথা। তবে রাশেদুন্নবী সবুজের আহ্বানে যোগ ঘটেছে প্রযুক্তির; বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিকাশের এ কালের সার্থক প্রকাশ ঘটেছে এখানে,
ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ ডট মেঘবালিকা ডট কম-এ ঠিকানায়।

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *