জরুরী অবস্থায় অতিজরুরী আর্ট-কালচার

❏ সাম্য রাইয়ান

স্বপ্নকে কি শেষ করা যায়? সমস্যার জালে বন্দি করে শ্বাসরোধ করা যায়? বরং সমস্যাই স্বপ্নের ইন্ধন যোগায়। সংকট ব্যতীত লেখক কিংবা শিল্পীর অস্তিত্বই সংকটে পড়তে বাধ্য। ফলত সে কিছু একটা করবেই। অন্তর্ঘাতও হতে পারে। হওয়া স্বাভাবিক৷

যখন লেখক-শিল্পীর স্বাধীনতা নেই; রাস্তায় দাঁড়ানোরও স্বাধীনতা নেই, নদীকূলে বসার অধিকার নেই, শুধুই নেই আর নেই। তখন তিনি কী করবেন? শেষ হয়ে যাবেন? ধারা-উপধারায় বিদ্ধ করে তাকে শেষ করা যায়?

জাফর পানাহির কথা ভাবুন। একজন ঘর-বন্দি চিত্র পরিচালক। ইরান সরকার যাকে জেলে ঢোকাবে বলে বসে আছে। ঢোকাতে পারেনি। মামলা চলছে। তিনি কী করে সিনেমা তৈরি   করবেন?

সেই অসম্ভবকে সত্যি করেছিলেন তিনি!

২০১১ সাল। মুখে মুখে বলা চিত্রনাট্য দিয়েই তৈরি হলো ঐতিহাসিক সিনেমা, ‘দিস ইস নট এ ফিল্ম’। ঘরের মধ্যেই সম্পূর্ণ শুটিং! বার্থডে কেকের মধ্যে গাঁথা পেনড্রাইভে বসে সেই সিনেমা পৌঁছে গেল কান ফেস্টিভালে।

(খ)
চিলির চিত্র-পরিচালক মিগুয়েল লিতিন৷ চিলি সরকার তাকে নির্বাসন দিয়েছিলো৷ কিন্তু তাঁর ইচ্ছে একটি ডকু-ফিল্ম নির্মাণ করবেন চিলির স্বৈরতন্ত্রের উপর৷ কীভাবে সম্ভব? একাজ করতে হলে চিলিতে ঢুকতে হবে, অনেককিছু দেখতে হবে, শুট করতে হবে তারপর ফিল্মে দেখাতে হবে৷

তিনি অসম্ভবকে সত্যি করে ফেললেন!
১৯৮৫ সালের গোড়ার দিকে নিজভূমে পরাধীন মিগুয়েল লিতিন ছয় সপ্তাহের জন্য ছদ্মবেশ ধারণ করে তিনটি টিম নিয়ে সিনেমা বানানোর উদ্দেশ্যে চিলিতে প্রবেশ করেন৷ স্বৈরাচারী পিনোচেতের আমলকে নিয়ে তিনি চার ঘন্টার একটি টেলিভিশন ফিল্ম এবং মূল ফিল্ম থেকে কেটেছেঁটে দুই ঘন্টার একটি ফিচার ফিল্মও নির্মাণ করেন৷ ১৯৮৬ সালে মাদ্রিদে যখন লিতিন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসকে তাঁর এ ফিল্ম নির্মাণ অভিজ্ঞতার কথা বলেন, তখন মার্কেস বুঝতে পারেন— এ ফিল্মের পিছনে লুকিয়ে আছে আরেকটি ফিল্ম, যা কখনো বানানো হবে না৷ তখন মার্কেস এ অভিজ্ঞতার বর্ণনা রেকর্ড করেন৷ তারপর এ বিবরণকে দশটি অধ্যায়ে ভাগ করে, কিছু নাম ও ঘটনায় সামান্য পরিবর্তন এনে রচনা করেন, ‘ক্ল্যান্ডেস্টাইন ইন চিলে দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অব মিগুয়েল লিতিন’৷ যেখানে এই রোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়৷

(গ)
মারিয়ো বার্গাস য়োসা বলেছিলেন, “লাতিন আমেরিকার আধুনিক উপন্যাসের জন্ম উরুগুয়ের ঔপন্যাসিক হুয়ান কার্লোস ওনেত্তির প্রথম উপন্যাস ‘এল পোসো’ (কুয়ো) প্রকাশের পর থেকে৷”

কে এই হুয়ান কার্লোস ওনেত্তি? কী আছে এ উপন্যাসে?

সময়টা ১৯৩০-এর দশক৷ উরিবুরুর মিলিটারী স্বৈরাচারী শাসনে নিষেধাজ্ঞা চলছে সপ্তাব্দে সিগারেট বিক্রি করা যাবে না৷ এসময় উরুগুয়ের লেখক হুয়ান কার্লোস ওনেত্তি ধূমপান করতে না পেরে অসহ্য হয়ে ধার করা টাইপরাইটারে উগরে দিলেন ৩২ পৃষ্ঠার উপন্যাস ‘এল পোসো’ (বাঙলায়: কুয়ো, ১৯৩৯)৷

কারফিউ তাকে ঐসময় রক্ত-মাংসের মানুষের কাছাকাছি যেতে দেয়নি, ফলে সেই সময়খন্ডটি তিনি কাটিয়েছেন কাল্পনিক চরিত্রদের সাথে৷ এ উপন্যাসে দেখা যায়, নায়ক এলাদিও লিনাসেরো সান্ধ্য আইনে ঘরবন্দি হয়ে পড়ে, যেখানে শুধু কল্পনা ও স্মৃতি ছাড়া বিশ্বের অন্য কোথাও তার প্রবেশাধিকার থাকে না৷ ফলে কল্পনা ও স্মৃতি-বাস্তবতার মধ্যে একটি অন্যতর জগৎ নির্মিত হয়৷

এইই হলো স্বপ্ন-কল্পনা, যার মধ্যবর্তী ড্যাসে লেখক বসে থাকেন৷ আর দেখেন, মাঝে মাঝে ধরলার সামান্য পানিতেই লাফিয়ে ওঠে এক জোড়া কালো ডলফিন, বন্ধুরা যাকে শুশুক বলে ডাকে৷

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *