❏ সাম্য রাইয়ান
কবিতার ফর্ম, তার শরীরে ছন্দ, অলংকার—এই সকলই চলে আসে কবিতার প্রয়োজনে। ফর্মটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি এমন কোনো ফর্মে লিখতে চাই না যা চর্বিতচর্বন। নতুন চিন্তা, যা আমি প্রকাশ করি, প্রচার করি; তা নতুন ফর্মেই প্রকাশ করতে পছন্দ করি।
এপ্রসঙ্গে জঁ লুক গোদার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সুবিমল মিশ্র লিখেছিলেন, ‘বলার ভঙ্গিটাই যখন বিষয় হয়ে ওঠে।’ কখনো কখনো এমনটাও হয়; আঙ্গিক নিজেই বিষয় হয়ে উঠতে পারে। আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রত্যেক লেখকের মধ্যেই থাকে; যদি তিনি ‘ক্রিয়েটিভ রাইটার’ হন।
কিছু কবিতার ক্ষেত্রে এই নিরীক্ষাচেষ্টাগুলো জ্বলজ্বল করে, কারণ সেই নিরীক্ষাগুলো বাহ্যিক, দৃশ্যমান। আমার শুরুর দিকের কবিতায় এমনটা হতো, সেগুলো আমি কোনো পুস্তিকা/বইয়ে জায়গা দেইনি৷ সবিনয়ে ফেলে দিয়েছি৷ সময় যতো বয়েছে কবিতায় বাহ্যিক, দৃশ্যমান নিরীক্ষা কমে তা কবিতার অন্তরে প্রবেশ করেছে।
আমার সকল বইয়েই নতুন কিছু কাজ আমি করতে চেষ্টা করেছি; নতুন শব্দবন্ধ, বাক্যগঠন, চিন্তায় নতুনত্ব...। কিন্তু তা পাঠকের পাঠপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে না। আমি কখনোই পাণ্ডুলিপি নির্মাণের ক্ষেত্রে স্রেফ সংকলন করি না, কনসেপচুয়ালী তাকে গড়ে তুলি। প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি কথা বলি, ‘লোকাল ট্রেনের জার্নাল’ বইয়ে এমন ধরনের গদ্য আমি লিখেছি, যা আমার জানামতে নতুন। ২০১১ থেকে এই ধরনের গদ্য আমি লিখতে শুরু করেছি।
রাঁধুনী কতটা এক্সপেরিমেন্ট করে তরকারি রেঁধেছেন এটা ভোজন রসিকের আগ্রহের বিষয় নয়; তার একমাত্র আগ্রহ স্বাদে। এক্সপেরিমেন্ট বা রন্ধন-কৌশল রাঁধুনীর ব্যক্তিগত বিষয়। সেই কারণে আমি লক্ষ্য রাখি, এক্সপেরিমেন্ট যেন পাঠ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত না করে।
ধরুন, একজন ইঞ্জিনিয়ার ভাবলেন বাসের সিট কভারে এত বছর এত এক্সপেরিমেন্ট করলাম, সবাই তার সুফল ভোগ করল—আরামে ভ্রমণ করলো; কিন্তু এর জন্য কত এক্সপেরিমেন্ট করতে হয়েছে তা নিয়ে যেহেতু কেউ কথা বলছে না, এবার একটা দারুণ এক্সপেরিমেন্ট করা যাক। এই ভেবে তিনি বাসের সিট কভারে তারকাটা গেঁথে দিলেন। বাসের যাত্রীরা এবার হারে হারে টের পেল ইঞ্জিনিয়ার এক্সপেরিন্ট করেছেন!
এই ধরনের লোক দেখানো এক্সপেরিমেন্ট আমি করি না। পেন ওয়ারেন তার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “এক্সপেরিমেন্টাল লেখা আবার কী? জেমস জয়েস কোনো এক্সপেরিমেন্টাল লেখা লেখেননি, তিনি ‘ইউলিসিস’ লিখেছেন। টি এস এলিয়ট ‘দি ওয়েস্ট ল্যান্ড’ লিখেছেন। যখন আপনারা একটা জিনিস ঠিক ধরতে পারেন না, তখনই তাকে এক্সপেরিমেন্ট বলে ফেলেন; এটা চাপাবাজির একটা অভিজাত শব্দ।”
আর আমাদের দেশে এক্সপেরিমেন্টের নামে গড়পড়তা যা চলে, তা হলো অজ্ঞতা আর চাতুরীর সমন্বয়৷ ৮০-৯০ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে যা হয়ে গেছে, ১৫০ বছর আগে ইউরোপে যা হয়ে গেছে, সেসবই এখানে এক্সপেরিমেন্ট বলে চালিয়ে দেয়া হয়৷ কিন্তু এটা তো কমনসেন্সের ব্যাপার, কোনো চিন্তা প্রথমবারই কেবল ‘এক্সপেরিমেন্ট’, পুনঃপুনঃ বছরের পর বছর চলতে থাকলে, তা যতো কম সংখ্যক লোকের দ্বারাই চর্চিত হোক না কেন, তাকে আর এক্সপেরিমেন্ট বলা চলে না৷
পরিষ্কারভাবে, এগুলো পাঠকের সাথে প্রতারণা৷ কেউ বুঝেশুনে এই ধরনের চাতুরী করে নাম কামাতে চায়, আর কেউ অজ্ঞতাবশত৷ এইই যা পার্থক্য৷