❏ সাম্য রাইয়ান
কর্পোরেট, ক্ষমতা (power) এর প্রভাবমুক্ত থাকতে না পারলে মুক্ত বা স্বাধীন চিন্তা চর্চা করা অসম্ভব। দুর্বৃত্ত পুঁজির করাল গ্রাস থেকে, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে না পারলে স্বাধীন সৃষ্টি অসম্ভব। একারণেই নতুন চিন্তা-বোধের কারিগর কোনোরূপ চিন্তার দাসত্ব করতে পারেন না। তা সে হোক মহৎ কিংবা হীন চিন্তা৷
ফলত প্রচলিত চিন্তা-পদ্ধতির চর্চাপথে হাঁটাচলা করতে না পেরে নতুন পথের নির্মাণ করতে গড়ে ওঠে লিটল ম্যাগাজিন৷ যে নিজেই নিজের পথ-নির্মাতা৷ গুচ্ছ গুচ্ছ নতুন পথের যাত্রীর আশ্রয়দাতাও সে-ই৷ যাকে সে আটকে রাখে না, সীমাবদ্ধ করে না; অসীম ছোঁবার স্বপ্নটি দৃঢ়তার সাথে উস্কে দেয়৷ একটি সত্যিকার লিটল ম্যাগাজিন লেখককে নিয়ন্ত্রণ করে না, লেখককে ধারণ করে৷ লেখকের হাতের সাথে পা বেঁধে কখনোই বলে না, ‘উড়ে যাও৷’ বরং বাঁধন খুলে দেয়ার গেরিলা ভূমিকা পালন করে সে৷ ব্যক্তিগত বাহিনী তৈরি করে কখনোই বলে না, অমুক লেখককে ঠেঙিয়ে এসো, তমুককে রগড়ে দাও! কিন্তু আমাদের বঙ্গদেশে এইহেন নীচশ্রেণির প্রতারণা সগৌরবে চলমান! এদের হাতেই বিপ্লবের ঠিকাদারী, এদের হাতেই যেন বিপ্লবের কপিরাইট! এরা ইচ্ছে হলে যা খুশি করতে পারে৷ জাতীয় কমিটি করতে পারে, আন্তর্জাতিক কমিটি করতে পারে, লিটলম্যাগ-জাতিগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বিবৃতি দিতে পারে, শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করতে পারে, লিটলম্যাগের নামে জুতোর দোকান দিতে পারে, লিটলম্যাগের সমিতি বানাতে পারে; এবং সকল কর্মকান্ডে ট্যাগলাইন দিতে পারে ‘সারাদেশের লিটলম্যাগ কর্মীদের পক্ষ থেকে!’ জ্বি এরই নাম প্রেম, প্রেমের নাম বেদনা… ও না স্যরি, এরই নাম ক্ষমতা, ক্ষমতার ডাক নাম ‘পাওয়ার’৷
পুরনো চিন্তারপথের এই যাত্রীগণ লিটল ম্যাগাজিনের কাঁধে তাদের পুরনোপন্থী নানারকম— মনের মাধুরী মেশানো এজেন্ডা চাপিয়ে লিটলম্যাগের চলন-বিচলন ভারাক্রান্ত করতে চান। যদিও তারা জানেন, এই সবরকম ফর্মেশন উল্টে দেয়াই লিটল ম্যাগাজিনের ধর্ম। লিটলম্যাগ— সে তো সকল প্রচল-প্রথার বিরূদ্ধে— যা কিছু প্রতিষ্ঠিত-আরোপিত— সেই সকল পদ্ধতি/সংজ্ঞার বেড়ি ভেঙে বেরিয়ে আসতে চায়। কবিতার মতোই সে স্বাধীন ও মুক্ত। প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তাপদ্ধতির সম্পূর্ণ বিপরীতে তার অবস্থান। পুরনো চিন্তা দিয়ে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার চেষ্টা বাতুলতামাত্র!
একসময় এদেশে লিটলম্যাগের একমাত্র এজেন্ডা ছিল দৈনিক পত্রিকায় গল্প-কবিতা ছাপানোর বিরোধিতা করা। অথচ লেখক কোথায় লিখবেন, না লিখবেন, এইটা সেকেন্ডারি ইস্যু। গোটা দুনিয়ায় ফার্স্ট ইস্যু হচ্ছে লেখক কী লিখবেন, কীভাবে লিখবেন, কেন লিখবেন। কিন্তু এইদেশে হলো উল্টো। লেখক কোন কাগজে লিখবেন, এটাই হয়ে গেল প্রধানতম আলোচ্য। ফলে শিল্পকলায় আর শিল্প নাই, রইলো শুধুই কলা। তারই ফলাফল এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। অবিকশিত এই মুভমেন্ট হাজামজাডোবা পুকুরে ডুবে রইল। ফলে সাহিত্য নির্বাসিত, লিটলম্যাগ মুভমেন্ট বিপর্যস্ত। অবস্থা নির্মম, দুঃখজনক।
তবুও থামে না প্রয়াস! কুমিরের খাঁজ কাটা গল্পের মতো লিখিত হতে থাকে দিস্তা দিস্তা এজেন্ডা, বস্তা বস্তা ধুলোবালির স্তুপ— গার্ডার ভেঙে যায়, তবু হুশ ফেরে না৷
দুঃখটা কী জানেন, যে লিটলম্যাগ প্রচল-প্রথার বিরুদ্ধে, তাতে এখন ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবিরের লোকেরাও ঢুকে গেছে নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে! যে লিটলম্যাগ সকল প্রকার ক্ষমতা-আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, তাতে এখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাতের নেতারাও ঢুকে গেছে নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে! যে লিটলম্যাগ সকল প্রকার আধিপত্যের বিরুদ্ধে, তাতে এখন কর্পোরেট ঢুকে গেছে নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে!
অথচ, লিটল ম্যাগাজিনের এজেন্ডা বলে যদি কিছু হয়, হতে পারে শুধু একটাই— লেখকের স্বাধীনতা!