মোকলেছুর রহমানের কবিতাবই ‘শেষ দৃশ্যের নায়ক’

❏  সাম্য রাইয়ান 

বইয়ের নামখানা এমনই তাৎপর্য ও রহস্যময়, পাঠককে অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে কাছে টানে৷ তারুণ্যের প্রথম উচ্ছ্বাস, প্রথম কবিতার বই৷ চৌষট্টি ডানায় উড্ডয়নের স্বপ্ন দেখার শুরু হলো প্রিয় মোকলেছুর রহমানের; ‘সব বৃক্ষ মহোদয় হয় না’ বইখানা দিয়ে৷ প্রথম এ বইতে তিনি সম্ভাবনা দেখিয়েছেন; আলোর বুদবুদ দেখিয়েছেন, নিকট জোনাকির মতো৷ 

আমি পাখি হতে চাই/ তুমি শামুক অথবা ব্যাঙ৷/ ডানা মেলি—/ উড়ে-উড়ে/ ঘুরে ঘুরে/ আনন্দ জাগাই৷
(উল্টো)

মানুষমাত্রই কখনো প্রেমিক কখনো বিদ্রোহী, কখনো স্বার্থপর, কখনো উদার৷ কখনোবা অবচেতনে হিংসুটে, আহাম্মক৷ কবিও মানুষ, না কি নামানুষ! কবি কখনো প্রেমের কথা বলেন কখনো বিদ্রোহী৷ সময়টা এমনই৷ দিকে দিকে অদৃশ্য আগুন জ্বলছে মগজে-মননে, দেখা যাবে না ছোঁয়াও যাবে না৷ এ আগুন নেভানোর জন্য নেই কোনো দমকল, নেই আয়োজন৷ কবি জানেন এই পোড়খাওয়া জীবনের ব্যথা৷ কেঁদে ওঠে তার মন৷ এ সমাজ তো এমনই; মতলববাজেরা আগুন লাগিয়ে ফায়ার ব্রিগেডে খবর দিতে ছুটে যায়৷ এসব ভণ্ড-প্রতারকের থেকে নিজেকে রক্ষাই যে সময়ে বড় চ্যালেঞ্জ, সে সময়ে বসে কবি লিখেন—
আমাদের মাথাগুলো/ আমাদের অজান্তে নিলামে ওঠে/ খুচরা ও পাইকারি বেচাকেনা হয়৷/ আমরা মাথা মাথা করে/ মাথাপাগল হয়ে যাই–
(আমাদের মাথাগুলো)

এমন সমাজ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর প্রত্যয় যেন ‘কাঠঠোকরা’ কবিতায় প্রকাশ পায়—
তোমার হৃদয় খুঁড়ে বাসা বানাতে/ পারলে হয়তো/ ঝড়ে ভিজতে হতো না আমায়৷
(কাঠঠোকরা)

এছাড়া উপায় কী? একা কবি, যেন সত্যশিশু এক— হেঁটে যায় বর্শামণ্ডপে৷ কবির অবস্থা বোঝা যায় ফসল ফলানোর কিছু শব্দে—
গহ্বরে অসংখ্য নৃশংসতা, অকস্মাৎ পড়েছি সেই গর্তে৷

কবির কিছু প্রেমানুভূতি সুন্দর, নির্মল৷ যেমন ‘দেখা হয় বায়ুর ঘ্রাণে’ কবিতায় কবি লিখেছেন—
আর দেখা হয় না আমাদের/ তবু বায়ুর ঘ্রাণে যেন,/ দেখা হয়ে যায়৷

‘নূপুর’ কবিতায় লিখেছেন—
সারাটি দুপুর/ তোমার নুপুর/ হৃদযন্ত্রে বাজে!/ চোখের তারায়/ নিজেকে হারাই/ দেহের ভাঁজে ভাঁজে৷

প্রেমে ডুবে কবি হারিয়ে যাননি, তিনি সমাজের অর্থনীতির রক্ত মুদ্রাকে দেখেছেন আপন আলোয়—
ক্রমাগত মুদ্রাযন্ত্রে বন্দী হয়ে যাচ্ছি/ মুদ্রার মতো৷/ এক হাত থেকে/ অন্য হাতে;/ পৌঁছে যাই/ ঘুরে-ঘুরে/ বিনিময় রোডে/ ব্যক্তিত্ব-বিবেক-চিন্তা ও মন৷
(মুদ্রাযন্ত্র)

সময়ের প্রেষণা কবির হৃদয়ে দাগ কাটে, মুগুঢ়ের মতো আঘাত করে, বেরিয়ে আসে শব্দ, কবিতা… মোকলেছুর রহমান দেখেন করোনা মহামারী, লিখেন—
অন্ধকার গিলেছে/ পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অব্দি,/ যেন একই সঙ্গীতের ধারাপাত,/ মহামারী! অণুজীব! মৃত্যু!
(অন্ধকার গিলেছে)

কবি সচেতন, কবি প্রতিবাদী, কবি নিঃশঙ্কচিত্তে লিখেন ধর্মকে ব্যবহার করে ভণ্ডামীর রূপ৷ উন্মোচন করে দেন কবিতায়৷ মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সেই অমর বাণী ‘ইশ্বর থাকেন ঐ ভদ্রপল্লীতে’ মনে পড়ে যায় মোকলেছুর রহমানের ‘ডট ডট ডট’ কবিতা পড়তে গিয়ে৷ মানিক যা লিখেছেন কথাসাহিত্যে মোকলেছ তা লিখেছেন কবিতায়৷ কবি মেনে নিতে পারেন না এসব নোংরামী৷ তাই তার ‘চোখ ফেটে রক্ত ঝরে,/ মগজ গলে তরল!/ … ভাবতেই সমস্ত দেহরস টগবগ করে ওঠে/ আর বিস্ফোরিত হয়ে যাই!’
কবি রাগান্বিত৷ কবি উত্তেজিত৷ কবি ক্ষুব্ধ৷ নবারুন ভট্টাচার্য যেমন লিখেছিলেন, ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না/ এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না’ তেমনই, এতদিন পর, আরেক নবীন কবি মোকলেছুর রহমান লিখলেন, 
এ দেশ রক্তের দেশ/ এ দেশ মৃত্যুর দেশ/ এ দেশ আত্মঘাতি দালালের/ মীর জাফরের দেশ/ এ দেশ ধর্ষিত দেশ৷
(বিস্ফোরিত হই)

৫৪টি কবিতা নিয়ে ৬৪ পৃষ্ঠার বইটির যথোপযুক্ত প্রচ্ছদ এঁকেছেন রাজীব দত্ত৷ ছাপা-বাঁধাই মনোরম৷ সব মিলিয়ে সুন্দর৷ যেহেতু প্রথম কবিতার বই, থাকুক দুর্বল কবিতা; ভাষায়, পোশাকে ছন্দপতন; সেসব বলার সময় আসেনি এখনো৷ কবির জন্য এখন শুধুই শুভকামনা৷ 

বই: সব বৃক্ষ মহোদয় হয় না
কবি: মোকলেছুর রহমান
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৩
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
দাম: ১৬০ টাকা
প্রকাশক: ঘাসফুল, ঢাকা

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *