❏ সাম্য রাইয়ান
যিনি ছাপাখানার লোকেদের বেশি টাকা দিতেন কারণ ওরা তাঁর বই ছাপতে চাইতো না পর্ণোগ্রাফীর অযুহাতে, যিনি লেখার ফর্মকেই বিষয় করে তুলেছিলেন, যিনি সম্পূর্ণ এক আলাদা পথ তৈরি করেছিলেন কথাসাহিত্যে, যিনি সন্দীপনের পর বাঙলা সাহিত্যে সবথেকে অধিক ইনোভেট করেছিলেন, যিনি পণ্যমুখী সাহিত্যের বিপরীতে শেষ পর্যন্ত লড়েছেন, সেই দুর্ধর্ষ সাহিত্যিক সুবিমল মিশ্র কিংবা সুবিমলমিশ্র গতকাল মারা গেলেন! শারীরিক সক্ষমতা, স্মৃতি আর দৃষ্টিশক্তিহীন হয়ে শেষ ক’টা বছর কাটালেন অনটনে, নির্জনে। এতে কার কতটা ক্ষতি হল! সুবিমলেরই বা কী এলো-গেল!
প্রচারের এতসব নিনাদের ভেতরেও সুবিমলমিশ্রের মৃত্যু একজন একলা লেখকের মৃত্যু। নিজের নিয়মে বাঘের মতো একাকী একজন লেখক বিচরণ করলেন বাংলা সাহিত্যে। সুখী গৃহকোণের দুঃখ নিয়ে তিনি কাহিনি লিখতে বসেননি। সুবিমল নিজে বেছে নিয়েছিলেন এই জীবন, এই চর্চা। গোটা একটা জীবন নিজের শর্তে কাটালেন, কারও পরোয়া করলেন না।
তিনি তথাকথিত সাহিত্য করতে আসেননি, যেভাবে লোকে সাহিত্য করে, এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ সাফল্য হিসেবে একটা সাহিত্য পুরস্কার বগলদাবা করে। তাঁর লেখা ছিল বাজারচলতি বাস্তবতাগুলিকে অবিশ্বাস করতে শেখানোর কৌশল। বিচিত্র কোলাজে যিনি মধ্যবিত্তের হিপোক্রেসিকে চিরে চিরে দেখিয়েছিলেন। সমাজের ভেতরকার গভীর, গভীরতর অসুখ তিনি দেখেছেন এবং সনাক্তির চেষ্টা করেছেন সব নষ্টামোর আর ধ্যাষ্টামোর শেকড়বাকড়৷ তিনি মধ্যবিত্তকে দাঁড় করিয়েছেন নিজস্ব ন্যাংটো প্রতিবিম্বের সামনে।
সুবিমলের লেখা শুধু সুবিমলের একক কর্মকাণ্ড নয়, তাতে থাকতে হয় পাঠকের অংশগ্রহণ৷ তিনি লেখার ভেতরে স্পষ্টভাবে সেই স্পেস রেখে দেন৷ তিনি যেভাবে নিজের শ্রেণি অবস্থানকে, নিজেকে ক্রমাগত আক্রমণ ও ভাঙচুর করেন, সুবিমলের পাঠকদেরও নিজের পাঠাভ্যাসকে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। লেখক ও পাঠকের এই আক্রমণ সহ্য করার ক্ষমতা না থাকলে সুবিমলের কথাসাহিত্য এগুনো যায় না৷
এসময়, বইমেলার এত বইয়ের ভিড়, হইচই, বিজ্ঞাপনের মাঝে তাঁর চলে যাওয়াটা প্রতীকী হয়ে থাকল!
[সুবিমল মিশ্র প্রয়াণের পরদিন লিখিত৷]