সাম্য রাইয়ানের সাথে দেশিক হাজরার আলাপ


[ভারতের অনলাইন ছোটকাগজ ‘এবং’ ২৩ জুলাই ২০২৩ তারিখে প্রকাশ করেছিল সাম্য রাইয়ান একক সংখ্যা। সেই সংখ্যায় এবং সম্পাদক দেশিক হাজরা নিয়েছিলেন সাম্য রাইয়ানের নিম্নোক্ত সাক্ষাৎকার। সংখ্যাটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।]
 
এবং পত্রিকা: বিন্দু পত্রিকার সম্পাদনা করছেন ২০০৬ সাল থেকে এবং এই পত্রিকা, আজকের দিনে ভারত ও বাংলাদেশের মিলিত উচ্ছ্বাস। আমাদের সকলেরই জানা। সম্পাদক হিসাবে নির্বাচনের জন্য সর্বপ্রথম আপনি কিভাবে একটি লেখাকে দেখেন—

সাম্য রাইয়ান: প্রধানত আমি দেখি লেখাটি নতুন কিছু দিতে পারছে কী না৷ সেটা হোক চিন্তায়, আঙ্গিকে বা অন্য কোনোদিকে৷ আমি আসলে নতুন লেখা, নতুন চিন্তা প্রকাশ করতে চাই; কবিতা, গদ্য, যা-ই হোক৷ যে লেখা সাধারনত, সচরাচর প্রচলিত পত্রিকাগুলো প্রকাশ করতে পারে না, চায় না; আমি সেধরনের লেখা প্রকাশে অধিক মনযোগী৷ আমি মনে করি, শুধু লেখা প্রকাশ করেই একটি লিটল ম্যাগাজিনের দায় শেষ হয়ে যায় না৷ সার্বিকভাবে একজন লেখককে পাঠকের সামনে উপস্থাপনের দায়ও লিটল ম্যাগাজিনের উপর বর্তায়৷ আনন্দের সাথে এই দায় বিন্দু বহন করে চলেছে এত বছর ধরে৷ ফলে তুমি খেয়াল করবে, এমন সব লেখক, যারা জনপ্রিয় না, গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু পাঠক তাদের সম্পর্কে খুব একটা জানেন না, বিন্দু তাদের নিয়ে আলোচনা, সাক্ষাৎকার এবং বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে৷

এবং পত্রিকা: আপনার বেশিরভাগ কাব্যগ্রন্থের নামকরণ দেখতে পাচ্ছি নিসর্গবর্ণনামূলক— যেমন ‘হলুদ পাহাড়’, ‘চোখের ভেতর হামিং বার্ড’, কিংবা সদ্য প্রকাশিত ‘হালকা রোদের দুপুর’ এই নামকরণ গুলির প্রসঙ্গে যদি দু চার কথা বলেন…

সাম্য রাইয়ান: তুমি বলার আগে আমি নিজেও এভাবে মিলিয়ে দেখিনি৷ আসলে এই কবিতাগুলো, যেগুলো নিসর্গপ্রবণ, সেগুলো আমার ব্যক্তিজীবনের চড়াই-উৎরাইয়ের সাথেই বোধয় সম্পর্কিত৷ কবিকে আমার কেবলই মনে হয়— জীবনব্যাপী সম্পর্কশাস্ত্র বিষয়ে গবেষণা করে চলা ব্যক্তি৷ সে নানান সম্পর্ক— প্রাণের সাথের প্রাণের, প্রাণের সাথে প্রাণহীনের, ক্ষুদ্রপ্রাণের সাথে মহাপ্রাণের…, সকল সম্পর্ক! এই প্রকারের সম্পর্ক স্থাপন— রক্ষা— চ্ছেদ— বিকাশ বিষয়েই মনে হয় কবিজীবনের সকল গবেষণা৷ সেই সম্পর্কশাস্ত্রেরই বহিঃপ্রকাশ কবিতাসকল৷ ২০১২ পরবর্তী সময়ে মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ আমার ব্যক্তিজীবনকে নির্মমভাবে আক্রান্ত করে তুলেছিলো৷ ‘পৃথিবী সিরিজ’ কবিতায় লিখেছিলাম, “মৃদু শব্দেরা খুব দূরন্ত হয়েছে/ আজকাল, ঘরবাড়ি তছনছ করে।/ আমার পৃথিবী হ’লো উল্টোপালক/ ভেঙে তছনছ—শ্রী একাকার!”

এত আঘাতে জর্জরিত হয়েই বোধকরি মানুষ থেকে দূরবর্তী হয়ে আমি প্রকৃতির নিকটবর্তী হয়েছি৷ অর্থাৎ মানুষকে বন্ধু বানানোর পরিবর্তে নিসর্গের বন্ধু হতে চেষ্টা করেছি৷ ‘ফুলকুমার’ কবিতায় লিখেছিলাম, “মানুষের প্রতি নিষ্ফল প্রণয়যান/ এড়িয়ে চলেছি আমি৷ দেখেছি/ সেসব জীবনের ব্যর্থ অভিযান৷”

আরেকটি কবিতার কথা মনে পড়ছে, ‘লিখিত রাত্রি ২০’, “ওরা চায় আমি পাগল হয়ে যাই, একা হয়ে যাই/ শহরে ঘুরিফিরি নিঃসঙ্গ মানুষ; আমার মৃত্যু হোক/ জলের অভাবে নির্মম: বর্ণনাতীত। অথচ কতো/ পাখি ফুল নদী বন্ধু হচ্ছে অকপটে; কী তুমুল/ আড্ডা দিচ্ছি আমরা। সুযোগ নেই, হবো: একলা-পাগল।”

এবং পত্রিকা: পাঁচের দশকের কবি, কবিতার অনিবার্য নাম উৎপলকুমার বসু এবং এই কাজের আগেও গদ্য রূপে উঠে আসে আরেকটি নাম আপনার কাছ থেকে সুবিমল মিশ্র (২০১৪)। তারপর সদ্য প্রকাশিত জন্মশতবর্ষে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (প্রবন্ধ সংকলন) এই নামগুলো বেছে নেওয়ার নির্দিষ্ট কারণ আছে কোন?

সাম্য রাইয়ান: উৎপলকু্মার বসু, সুবিমল মিশ্র কিংবা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, এঁদের সাহিত্যের প্রতি ব্যক্তিগত ভালো লাগা তো আছেই৷ সুবিমল মিশ্রকে নিয়ে যে পুস্তিকাটি লিখেছিলাম, সেটি ছিলো তাঁর সাহিত্য পড়তে পড়তে লিখিত নোটের সংকলন৷ এরপর উৎপলকুমার বসুকে নিয়ে সাত বছর ব্যাপী যে কাজটা করেছিলাম, সেটার কারন উৎপল পরবর্তী সময়ের কবিদের কবিতায় তাঁর প্রভাবের তীব্রতা; যা দেখে আমি প্রকৃতপ্রস্তাবে এর কারন অনুসন্ধান করতে চেয়ে ছিলাম৷ আবার যখন দেখলাম শারীরিক প্রয়াণের পর উৎপলকুমার বসুর কবিতা আরো তীব্রতর হয়ে উঠছে বাঙলা মুলুকে, তখন আরো বেশি আগ্রহী হলাম এর কারন জানতে৷ বাঙলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অর্ধ শতাধিক লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্লেষণ একত্রিত করে এই সংকলন প্রকাশ করেছিলাম৷ আর ওয়ালীউল্লাহ’র কথা নতুন করে কী বলবো! তিনি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাঙলা সাহিত্যের অন্যতম স্মার্ট কথাসাহিত্যিক৷ আমি ভেবেছিলাম তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে বাঙলাদেশে অনেকেই অনেক উদ্যোগ নিবেন৷ কিন্তু আমি হতভম্ব হয়ে লক্ষ্য করলাম কেউই তাঁর শতবার্ষিকী প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশের উদ্যোগ নিলেন না৷ এত বড় অসম্মান মেনে নিতে পারলাম না৷ তাই বিন্দুর পক্ষ থেকেই উদ্যোগ নিয়েছিলাম ‘জন্মশতবর্ষে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’ প্রবন্ধ-সংকলন প্রকাশের৷

এবং পত্রিকা: আমার শেষ প্রশ্ন, এই দশকের আপনার প্রিয় কবি—

সাম্য রাইয়ান: গত দুই দশকে এত এত ভালো কবিতা লেখা হয়েছে, হচ্ছে, যা অভাবনীয়৷ আগের দশকগুলোতে আমরা যেমনটা দেখেছি কয়েকজনমাত্র কবি উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন, ভালো কবিতা লিখছেন, কিন্তু দুই হাজার পরবর্তী সময়ে আমরা তেমনটা দেখছি না৷ এসময়ে একসাথে অনেকেই ভালো লিখছেন, উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন৷ যেন একটা বিকেন্দ্রীকরণের মতো ঘটনা ঘটছে৷ এইটা নতুন ঘটনা বাঙলা সাহিত্যে৷ ফলে অগ্রজরা অনেক ক্ষেত্রেই কনফিউজড হয়ে যাচ্ছেন এই সময়ের কবিতা আলোচনায়, চিহ্নায়নে৷
আর এই দুই দশকে আমার প্রিয় কবি, প্রিয় কবিতার সংখ্যা অনেক৷


 
সাম্য রাইয়ান | কুড়িগ্রাম, বাংলাদেশ